গোলাম রাশিদ: সময়ের কষ্টিপাথরে যাচাইয়ের সময় অনেক কিছুই হারিয়ে যায়। যখন একটি সংবাদপত্রের কথা উঠে আসে, তখন সময়কে জয় করে ‘কালজয়ী’ হয়ে ওঠাটাই তার সাফল্য। একটি খবরের কাগজ শুধু সময়ের ভাষ্য তুলে ধরে না, চিত্রিত করে সমাজকে। তুলে ধরে তার সুখ-দুঃখ। তুলে ধরে অবহেলিত, পিছিয়ে পড়া মানুষের কথা।
‘কলম’ ৪২ বছর ধরে সেই কাজ করে চলেছে অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে। শনিবার আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্ক সার্কাস ক্যাম্পাসের দ্বিতীয় অডিটোরিয়ামের আলোচনাসভায় উঠে এল সেই ইতিহাস ও উত্তরাধিকারের কথা। বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব, বুদ্ধিজীবী ও সাংবাদিকদের কথায়-স্মৃতিতে দেশভাগ-পরবর্তী পশ্চিমবাংলার মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানস গঠনে কলম-এর ভূমিকা উঠে আসে এদিন।
শুধু নির্ভরযোগ্য সংবাদ পরিবেশন নয়, ইতিহাস-সাহিত্য-সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক হিসেবেও ‘কলম’ তার যাত্রা জারি রেখেছে চার দশক ধরে। এদিন মুখ্য বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন প্রাবন্ধিক খাজিম আহমেদ ও জাহিরুল হাসান।
এছাড়াও কলম ও পুবের কলম-এর ৪২ বছরের যাত্রার সামগ্রিক পথচলা নিয়ে মনোজ্ঞ আলোচনাসভায় উপস্থিত ছিলেন আল-আমীন মিশনের সাধারণ সম্পাদক এম নুরুল ইসলাম, প্রাক্তন সরকারি আধিকারিক আরফান আলি বিশ্বাস, রাজনীতিক ওয়ায়েজুল হক, গিয়াসুদ্দিন আমেদ, মহিউদ্দিন সরকার, ঈশিতা সুর, প্রাক্তন পুলিশ অফিসার মসিহুর রহমান, আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার সৈয়দ নুরুস সালাম, অধ্যাপক সাইফুল্লা, সোনা বন্দ্যোপাধ্যায়, অধ্যাপক সুরঞ্জন মিদ্দে, জাইদুল হক, পুবের কলম-এর ম্যানেজার কাজী আলি আকবর, শফিকুল ইসলাম, শাহ আলম, শাহিদ আকবর, ফারুক আহমেদ প্রমুখ। কলম-এর যাত্রাপথে নানাভাবে অবদান রাখার জন্য এদিন দু-জন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব জনাব আমিনউদ্দিন সিদ্দিকি ও জনাব হাজি মুস্তাককে সংবর্ধিত করা হয় পুবের কলম-এর তরফ থেকে।
‘কলম’ মাসিক ম্যাগাজিন হিসেবে তার যাত্রা শুরু করেছিল ১৯৮১ সালের নভেম্বরে। পর্যায়ক্রমে পাক্ষিক ও সাপ্তাহিকের পর্ব পেরিয়ে এটি এখন সংখ্যালঘু সমাজের শ্রেষ্ঠ প্রতিনিধিত্বকারী দৈনিক সংবাদপত্র হিসেবে উঠে এসেছে বলে এদিন মতপ্রকাশ করেন সুধীজনেরা। প্রথম থেকেই ‘ইনভেস্টিগেটিভ জার্নাজিলম’-এ জোর দিয়েছে কলম।
তুলে ধরেছে মাইনোরিটি মুসলিমদের আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা। প্রথম থেকেই এই পত্রিকাটির প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক এবং পরিচালকের দায়িত্ব পালন করে চলেছেন আহমদ হাসান ইমরান। খাজিম আহমেদ কলম-এর মূল্যায়ন প্রসঙ্গে বলেন, বিভাগ-পরবর্তী পশ্চিম বাংলায় অপেক্ষাকৃত বঞ্চিত এক জাতিসত্তার কথা তুলে ধরেছে ‘কলম’।
বাংলায় মুসলিম সাংবাদিকতার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস তুলে ধরতে গিয়ে তিনি ১৯৩৬ সালে মাওলানা মোহাম্মাদ আকরম খাঁ-র দৈনিক ‘আজাদ’-এর ঐতিহাসিক অবদানের কথা উল্লেখ করেন তিনি। ইতিহাসবেত্তা খাজিম আহমেদ বলেন, মাত্র দশ বছরে বাঙালি মুসলমানের মর্যাদা ও পরিচয়ের কথা তুলে ধরেন মাওলানা আকরম খাঁ। কলেজ স্ট্রিটের গোলদিঘি থেকে তালতলার গোলদিঘির দূরত্ব খুবই কম। তবে বৌদ্ধিক দিক থেকে অনেক পিছিয়ে।
সেই পিছিয়ে পড়া জাতির চিন্তার উদ্গমন ঘটছে সেই সময় থেকেই। এ প্রসঙ্গে বাঙালি মুসলিম সাংবাদিকতার পথিকৃৎ হিসেবে তিনি আকরম খাঁ, আবুল মনসুর আহমেদ ও আবুল কালাম শামসুদ্দিনের নাম উল্লেখ করেন। তিনি কলম-এর জন্মলগ্নের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরে বলেন, বিভাগ-পরবর্তী সময়ে আবদুল আযীয আল-আমানের ‘জাগরণ’, ‘কাফেলা’ ছাড়াও ‘পয়গাম’, ‘নেদায়ে ইসলাম’, ‘কুরআন প্রচার’-এর মতো পত্রপত্রিকা এই বাংলায় মুসলিম বৌদ্ধিক চর্চার বাতি জ্বালিয়ে রাখে। সেই সময় কারমাইকেল হস্টেলের তরুণ তেজী যুবক ইমরানের ‘আত্মপ্রকাশ’।
ইতিহাসবিদ খাজিম আহমেদের মতে,দেশভাগের পর ‘কলম’-এর প্রকাশ একটি ঐতিহাসিক ও তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। আকরম খাঁ-র পরে একটি নিয়মিত দৈনিক কাগজ প্রকাশ করলেন আহমদ হাসান ইমরান। এটা দেশলাই কারখানা নয়, এটা সাহসের বিষয়। এর জন্য নিরন্তর কোচবিহার থেকে কাকদ্বীপ ছুটে বেড়িয়েছেন আহমদ হাসান। বাঙালি মুসলিম জাতিসত্তার অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে সিপাহসালার হলেন ইমরান।
গবেষক-প্রাবন্ধিক জাহিরুল হাসান তাঁর ভাষণে বলেন, আমি চিন্তার ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদী, যে চায় পাশের ‘সালতানাত’কে গ্রাস করতে। ক্ষুদ্র জায়গায় আবদ্ধ থাকলে হবে না। তৈরি হন বড় পরিসরের জন্য। আমার বেদনা হয় যখন কেউ বলেন ‘কলম’ মুসলিম পত্রিকা। এটা মনে রাখতে হবে ‘কলম’ কিন্তু সাম্প্রদায়িক পত্রিকা নয়। কলম একটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পত্রিকা। কলম একটি জানালা। ৪২ বছর পরে যদি কলমকে আত্মসমীক্ষা করতে হয়, তবে দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। ছোট্ট পাড়ার মধ্যে আবদ্ধ থাকলে হবে না।
‘কলম’-প্রসঙ্গে নানা স্মৃতিচারণায় ভরপুর ছিল এদিনের অনুষ্ঠান। পাশাপাশি বিশিষ্ট সমাজসেবী, সাংবাদিক, কর্মীদের সংবর্ধিত করা হয় এদিন। সমাজসেবী জনাব হাজি মুস্তাক সংবর্ধিত হয়ে জানান, আমি উর্দুভাষী। বাংলা ভালো বলতে পারি না। কলম-এর ইমরানের সঙ্গে সাক্ষাৎ ত্রিশ বছর আগে। তিনি যেভাবে নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে চলেছেন তার জন্য শুভেচ্ছা। জনাব আমিনউদ্দিন সিদ্দিকি সংবর্ধনা পাওয়ার পর ধন্যবাদ জানাতে উঠে বলেন, ‘কলম’ শুরু হয়েছিল আমাদের উর্দুভাষী বাঙালি ও বাংলাভাষী বাঙালির মধ্যে সেতু তৈরির প্রয়াস হিসেবে। কলম-এর প্রেস নেই।
তারপরও ইমরান সাহেব কীভাবে ‘কলম’ চালান ভেবে আশ্চর্য হতে হয়। কলম-এর সর্বাঙ্গীন উন্নতির জন্য সারাজীবন পত্রিকার পাশে থাকবেন বলে জানান তিনি। এ প্রেক্ষিতে সম্পাদক তথা মাইনোরিটি কমিশনের চেয়ারম্যান আহমদ হাসান ইমরান জানান, সাপ্তাহিক কলম থেকে আমাদের সাহায্য করে চলেছেন আমিনউদ্দিন সাহেব। উর্দুভাষী একজন মানুষ বাংলা মিডিয়ার জন্য যা করেছেন তা অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। পতাকা গ্রুপের কর্ণধার শিল্পপতি আলহাজ মোস্তাক হোসেন, সাজাহান বিশ্বাসের মতো ব্যক্তিত্বরাও বিভিন্ন সময়ে কলমকে নানাভাবে সাহায্য করেছেন বলে কৃতজ্ঞতা জানান আহমদ হাসান ইমরান।
প্রাক্তন পুলিশ আধিকারিক মসিহুর রহমান বলেন, কূপমণ্ডূক মানুষ ‘কলম’কে সাম্প্রদায়িক আখ্যায় ভূষিত করেছে। এতে তাদের সুবিধা হবে বলেই করেছে। দেশভাগের পর মুসলমানদের সমাজ-সংস্কৃতির প্রতিনিধি হিসেবে ‘কলম’ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। বৃহত্তর মুসলিম সমাজের প্রতিফলন ঘটছে কলমে। প্রাবন্ধিক আলিমুজ্জমান বলেন, দৈনিক পত্রিকা হিসেবে পুবের কলমেই আমি প্রথম লিখেছি। অবহেলিত মানুষের কথা বলে ‘কলম’।
আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার সৈয়দ নুরুস সালাম বলেন, বহু পত্রিকা পড়ি। কিন্তু যখন ‘পুবের কলম’ পড়ি তখন মনে হয় যেন মায়ের সঙ্গে কথা বলছি। এই পত্রিকা পিছিয়ে পড়া শ্রেণি ও মুসলমানদের কথা বলে। তবে এটি সাম্প্রদায়িক কাগজ নয়। এটি সবার কাগজ। জনাব মহিউদ্দিন সরকার জানান, আমার প্রথম লেখা পুস্তক ‘মক্কা মদিনার পথে-প্রান্তরে’ ইমরানই ছাপিয়েছিলেন ‘কলম’ থেকে। এটি সাপ্তাহিক কলমে প্রকাশিত হয়েছিল ধারাবাহিক ভাবে। জনাব ওয়ায়েজুল হক বলেন, গুটি গুটি পায়ে ৪২ বছরে কলম। ইমরান সাহেবের সহধর্মিণী মরহুমা ইয়ামিন হাসানের আত্মত্যাগও এর পিছনে বড় অবদান রেখেছে। নীরবে-নিভৃতে তিনি কলম-এর জন্য কাজ করে গেছেন। কলম মিল্লাতের কাগজ। কলম যাতে ভবিষ্যতে আরও বড় আকার ধারণ করে সে-নিয়ে ব্লুপ্রিন্ট তৈরি করতে হবে। আরও বড় অডিটোরিয়ামে ৫০ বছর পূর্তি পালন করতে হবে।
এদিন অসুস্থ সাংবাদিক-সম্পাদক সেখ সদর নইমের জন্য দোয়া করা হয় সভার শুরুতেই। কুরআন তিলাওয়াত দিয়ে সভা শুরু করেন শাহিদ আকবর। ‘ছায়ানট’-এর সোমঋতা মল্লিক নজরুল গীতি ‘জেরিন হরফে লেখা’, ‘কাণ্ডারী হুঁশিয়ার’ পরিবেশন করেন। ইমরান জানান, এপার বাংলায় নজরুলচর্চায় নতুনভাবে প্রাণ দিয়েছেন সোমঋতা।
‘কলম’ পরিবারের পুরনো সদস্যদের মধ্যে ম্যানেজার কাজি আলি আকবর, মুহাম্মদ আইয়ুব হাসান, শফিকুল ইসলাম, আলাউদ্দিন মোল্লা, জাইদুল হক, সুব্রত গুপ্ত, সাঈদ আহমেদ, আবদুল ওদুদ, এস কে সাইফুদ্দিন, নাসিম সর্দার, আবদুল হান্নানকে সংবর্ধিত করা হয় এদিন। আহমদ হাসান ইমরান-সম্পাদিত ‘প্রফেট মুহাম্মদ সা. জীবনচরিত বনাম সমালোচনার যৌক্তিকতা’ বইটির আনুষ্ঠানিক প্রকাশ হয় এদিন।
নবী সা.-এর জীবনী মুসলিম ও অমুসলিমদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে বিতরণ করার জন্য এই বইয়ের ৫ হাজার কপি কেনার কথা ঘোষণা করেন জনাব আমিনউদ্দিন সিদ্দিকি। এদিনের পুরো অনুষ্ঠানটি সেজে উঠেছিল স্মৃতিচারণা, মূল্যায়নের মধ্য দিয়ে। দূরদূরান্ত থেকে এসেছিলেন দর্শকশ্রোতারা। দর্শক আসনেও ছিলেন বহু বিশিষ্ট ব্যক্তি। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন আহমদ হাসান ইমরান এবং নেপথ্যে থেকে তাঁকে সহযোগিতা করেন সুমনা দাস।