শেখর গুপ্তা: মোদি সরকারের দ্বিতীয় দফার বর্ষপূর্তিতে তারা নিজেদের ‘অর্জন ও সাফল্যে’র প্রচার করে চলেছে। এটাই প্রশ্ন করার সঠিক সময়। কাশ্মীর নীতি কি সফল, ব্যর্থ নাকি একই রয়ে গেছে? পূর্বতন সরকারগুলিকে বিজেপি অভিযুক্ত করে এসেছে যে, কাশ্মীর নিয়ে তারা জলঘোলা করেছে। আমরা যদি সাম্প্রতিক নিশানাকৃত হত্যাগুলি, বিশেষত বহিরাগত ও কাশ্মীরি পণ্ডিতদের কথা ধরি তাহলে মোদি সরকারের পন্থাকে ব্যর্থতাই বলতে হবে। আমরা তিনটি যুক্তির কথা বলব।
প্রথম, নীতি-মূল্যায়ন এপিসোডিক হলে চলবে না। দ্বিতীয়, কাশ্মীর উপত্যকার হিংসাকে ভৌগোলিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা দরকার। আমরা টিভি চ্যানেল নই যে, কোথাও লাফিয়ে পড়ে অ্যাপক্যালিপসের ঘোষণা করব। ঘোষণা করব ১৯৯০ সালের পুনরাবৃত্তি ইত্যাদি। আমরা আমাদের আগুন ধরে রাখি। এবং তৃতীয় হল, কেউ যদি মনে করেন যে, ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট কাশ্মীর সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে, তাহলে তাঁদের কাশ্মীর ১০১ পুনর্পাঠ করা জরুরি। সাংবিধানিক পরিবর্তনকে বিজেপি, আরএসএস ও তাদের সমর্থকরা উদযাপন করে এই ভেবে যে, তাদের অন্যতম মতাদর্শিক লক্ষ্য পূরণ হয়েছে। নাগরিক খুনের (অধিকাংশই নিশানাকৃত) মোট সংখ্যাটা যদি দেখা যায়, তাহলে এ পর্যন্ত নিহত হয়েছে ২৯ জন। ২০২১ সালের ৫ অক্টোবরে জনপ্রিয় ফার্মাসিস্ট এম এল বিন্দ্রুর হত্যার তারিখ থেকে গণনা শুরু করা হয়। উপত্যকায় যেমনটা সচরাচর ঘটে থাকে, সেই নিরিখে এই সংখ্যাটা বেশি বা কম নয়। বস্তুত, দক্ষিণ এশিয়ার সন্ত্রাসবাদ পোর্টালের (এসএটিপি) দেওয়া তথ্যের দিকে যদি তাকানো যায়, তাহলে দেখব, ২০১০ সাল থেকে কাশ্মীর উপত্যকায় একটা বিষয় অপরিবর্তিত রয়েছে, আর সেটা হল, নাগরিক হত্যার সংখ্যা। নরেন্দ্র মোদির বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে মসনদে বসার চার বছর আগেও এই সংখ্যাটা প্রতি বছর ১৯ থেকে ৩৪ এর মধ্যে ঘোরাফেরা করত। দুই দফার মোদি রাজত্বেও এর কোনও ব্যত্যয় ঘটেনি।
বরং ২০১৮ সালে নিহতের সংখ্যা পৌঁছায় ৮৬-তে। ২০১৪ সালের মে মাসের আগে উপত্যকার পরিস্থিতি যদি নারকীয় হয়, তাহলে এখন তা স্বর্গীয় নয়। বিপরীতটাও সত্য। আপনি যদি মোদি বা বিজেপির সমর্থক হন তাহলে বুকে হাত রেখে বলুন, উপত্যকার দীর্ঘদিনের এই চিত্র দেখে আপনি হতাশ নন?
২০১৪ সালে মোদি ও তাঁর দল যখন প্রচার করেছিল, তখন তারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে, কাশ্মীর নিয়ে তারা আরও দৃঢ় ও কঠোর অবস্থান নেবে। অতীতে সমস্ত গ্লানি ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার প্রতিশ্রুতিই তো তাঁরা দিয়েছিলেন।
১৯৯০ সালে কাশ্মীরি পণ্ডিতদের পরিযায়ন ও ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলির ব্যর্থতাকে দুর্বল সরকারের উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছিল। মোদি সরকার সমস্ত সন্ত্রাসবাদীকে, সে ভারতীয় হোক বা পাকিস্তানি, দেখিয়ে দেবে যে, তাদের খেল খতম। তারপর মাসের পর মাস গড়িয়ে গেছে, সন্ত্রাসবাদীদের কার্যকলাপ থেকে প্রতীয়মাণ হয়েছে যে, তারা ওই প্রচারকে বিশ্বাস করে না।
‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’ নিয়ে হিন্দুত্ববাদীদের ব্যাপক ও বন্য উদযাপন কৌশলী দ্বার উন্মোচিত করে দিয়েছে। বিজেপির বিপুল পৃষ্ঠপোষণা লাভ করা চলচ্চিত্রটি প্রতিষ্ঠিত করেছে যে, কাশ্মীরি পণ্ডিতদের উপর নিপীড়ন হয়েছে, হত্যা হয়েছে, ১৯৯০ সালে কাশ্মীরে এক ধরনের ‘জনগোষ্ঠী সাফাই’ অভিযান চলেছে। এর কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, সরকার ছিল দুর্বল ও কাপুরুষ। জঙ্গিরা আবার যদি কাশ্মীরি পণ্ডিতদের হত্যা করা শুরু করে তাহলে একে আপনি কী বলবেন?
পর্যটক ও অমরনাথ তীর্থযাত্রীদের সংখ্যা দেখে বিভ্রান্ত হওয়ার কিছু নেই। গত দুই দশকেও এমন সু-সময় বহুবার এসেছে। উপত্যকায় আসল পরীক্ষাটা হল, বাইরে থেকে কাজ করতে আসা শ্রমিকদের কতখানি নিরাপদে রাখতে পারছেন ও স্থানীয় পণ্ডিতরা কত মসৃণভাবে সেখানে ফিরে যেতে পারছে। সেটা কিন্তু বদলায়নি।
পুনরায় বলি, আপনি যদি মোদি সরকারের অন্ধ ভক্ত হন এবং এই সব বলার জন্য আমার প্রতি ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে প্রশ্ন করেন যে, আপনি কীভাবে প্রত্যাশা করেন ৭০ বছরের বেশি সময় ধরে নেহরু-গান্ধি-আবদুল্লা-মুফতি, পাকিস্তান ও ইসলামি মৌলবাদের দ্বারা জটপাকানো পরিস্থিতিকে মোদি সম্পূর্ণভাবে স্বাভাবিক করে দেবেন? সময় লাগবে। আপনাকে ধৈর্য্য ধরতে হবে। সংক্ষেপে এটাই আমার বলার বিষয়। সমস্যাটার সূচনা হয়েছে এই বিশ্বাস থেকে যে, স্বাধীন ভারতের প্রকৃত ইতিহাস শুরুই হয়েছে ২০১৪ সালের গ্রীষ্ম থেকে।
এর আগে যা কিছুই হয়েছে তা ছিল জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সমঝোতা ও আপোস। আপনি একবার যদি এই ধারনায় স্থিত হয়ে যান, তাহলে আপনি কাশ্মীর সহ সর্বত্র নতুনভাবে ইতিহাস তৈরি করতে চাইবেন। উরি, বালাকোট, ৩৭০ ধারা, দ্য কাশ্মীর ফাইলস–উদযাপন করার মতো আপনি প্রচুর কিছু পেয়ে যাবেন।
এবং তখনই আপনি দেখবেন, আপনার কাগজের দৈনন্দিন শিরোনামের মধ্যে তেমন কোনও তফাত নেই। হিন্দুদের হত্যা, বিশেষ করে পণ্ডিত। টিভির সেনানায়করা আগের মতোই উত্তেজিত ও বিস্ফোরক। পাকিস্তানিদের শিক্ষা দেওয়া হোক, অপবিত্র জেহাদি মানসিকতার উপর পবিত্র ধর্মযুদ্ধ শুরু করা হোক ইত্যাদি। এইবার আমি আপনাদের প্রশ্নগুলি আপনাদের দিকে ঘুরিয়ে দিই।
আপনারা কি সত্যিই প্রত্যাশা করেন যে, দুটি পারমাণবিক শক্তিধারী প্রতিবেশী দেশ যাদের জোরালো সেনাবাহিনী রয়েছে এবং পরস্পরকে সম্পূর্ণভাবে অবিশ্বাস করে, তাদের মধ্যেকার ক্রনিক সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে কেবলমাত্র আপনাদের পছন্দের সরকারকে ভোট দিয়েছেন বলে? কাশ্মীরের দরকার ধৈর্য্য, বাস্তববাদ এবং একটু সাহস করে বললে, নম্রতা। ঈশ্বর না করুন, আবার কোনও ভয়াবহ সন্ত্রাসী আক্রমণ যদি হয়, তাহলেও কোনও শিরোনাম কাশ্মীরকে ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলবে না। ২০১৯ সালের ৫ আগস্টের মতো কোনও শিরোনামও নির্মূল করতে পারবে না এই সংকটকে।