পুবের কলম, ওয়েবডেস্ক: দিল্লিতে লিভ ইন সঙ্গীর দেহ ৩৫টি টুকরো করে কুচিয়ে ফ্রিজে রেখে দেওয়ার ঘটনা মনে করিয়ে দিল ১২ বছর আগে ঘটে যাওয়া অনুপমা গুলাটি হত্যাকাণ্ড। দেরাদুনের এই ঘটনা দেশকে তোলপাড় করেছিল। ২০১০ সালের ১৭ অক্টোবর স্বামী রাজেশ গুলাটির হাতে নির্মমভাবে খুন হন অনুপমা গুলাটি। শ্বাসরোধ করে খুন করে অনুপমার দেহ ৭২ টুকরো করে কুচিয়ে ডিপ ফ্রিজারে রেখেছিলেন রাজেশ। পুলিশকে সেই সময় রাজেশ জানিয়েছিলেন, এক হলিউডের সিনেমা দেখে এই খুনের ফন্দি এঁটেছিলেন তিনি। আর ১২ বছর পর পুলিশকে নির্বিকার চিত্তে দিল্লি নিবাসী এক ২৮ বছরের যুবক আফতাব আমিন পুনাওয়ালা জানালেন নিজের বান্ধবী, লিভ ইন পার্টনারকে খুন করে দেহের ৩৫টি টুকরো করে ফ্রিজে রেখেছিল সে। এত নির্বিকার চিত্তে নৃশংস ঘটনা ঘটানো আফতাবের এই চরিত্র ভাবিয়ে তুলছে দিল্লি পুলিশকে।
নিজের হাতে খুন করে বান্ধবীর দেহ ৩৫ টুকরো করে ফ্রিজে ‘পরম যত্নে’ সাজিয়ে রেখে, সেই আবাসনেই অন্যান্য বান্ধবীদের নিয়ে উদ্দাম যৌনতায় মেতে উঠতেন আফতাব আমিন পুনাওয়ালা। দক্ষিণ দিল্লির ছত্তরপুর পাহাড়ি এলাকা ৯৩/১ নম্বর ফ্ল্যাটে প্রায় প্রতিদিনই ছিল নিত্য নতুন বান্ধবীদের যাতায়াত। ঘরে আসা তরুণীরা ঘুণাক্ষরেও জানতে পারেননি, ফ্রিজে রয়েছে একটি দেহ। সেটা ৩৫টি টুকরো করে কাটা। শ্রদ্ধা ওয়াকারকে খুন করে তার দেহ ছোট ছোট টুকরো করে ৩০০ লিটারের কেনা ফ্রিজে ঢুকিয়ে রেখেছিলেন আফতাব। আফতাবের বন্ধু, ফুড ডেলিভারি বয় সহ আরও অনেকেই ওই ফ্ল্যাটে এসেছেন গত কয়েক মাসে৷ আফতাব কতটা নৃশংস, তাঁরাও কেউ টের পাননি৷
সব সময় ঘরে ধূপ, রুম ফ্রেশনারের জোরালো গন্ধ, পচা দুর্গন্ধ দূর করতে উগ্র কেমিক্যাল ছড়ানো থাকত। আরও চাঞ্চল্যকর বিষয়, যে ফ্রিজে শ্রদ্ধার দেহ ছিল, সেখানেই খাবার রাখতেন আফতাব।
গত শনিবার গ্রেফতারের পরে পাঁচদিনের পুলিশি হেফাজতে ২৪ ঘণ্টার সিসি ক্যামেরার নজরদারিতে জেলে রয়েছেন আফতাব। সেখানে অন্যান্য বন্দিদের সঙ্গে রাখা হয়েছে তাকে। এই ধরনের একটা হাড়হিম করা কাণ্ড ঘটানোর পরেও নির্বিকার আফতাব আমিন পুনাওয়ালা। আফতাবের এই চরিত্র পুলিশকে আরও ধন্দে ফেলেছে।
চলতি বছরের ১৮ মে খুন হন শ্রদ্ধা। তার পরে প্রায় ছয়মাস সেই আবাসনে কাটিয়ে দিলেন আফতাব। এই দীর্ঘ কয়েকটা মাসের মধ্যে ১৮ দিন ধরে প্রতিদিন মধ্যরাতে খোলা হত সেই ফ্রিজ। যখনই শ্রদ্ধার কথা খুব মনে পড়ত, তখনই ‘বান্ধবী শ্রদ্ধার’ ট্রেতে রাখা কাটা মাথা বের করে দেখে নিতেন তিনি। এই দীর্ঘ সময় ধরে শ্রদ্ধার শরীরে প্যাকেটে মুড়ে রাখা দেহের টুকরো অংশগুলি মেহরাউলির জঙ্গলে ছড়িয়ে দিয়েছিল সে।
ইতিমধ্যেই পুলিশের হাতে বেশ কিছু তথ্য এসেছে। যার হাত ধরে আফতাবের এক বন্ধুর সন্ধান পেয়েছে তারা। যে বন্ধুটি আফতাব ও শ্রদ্ধার কমন ফ্রেন্ড ছিল বলেই জানা গেছে। পুলিশ মনে করছে সেই ‘কমন ফেন্ড’কে জেরা করে ঘটনা সম্পর্কিত আরও তথ্য তাদের হাতে আসবে। তবে তদন্তের স্বার্থে পুলিশ সেই কমন ফেন্ডের নাম পরিচয় গোপন রেখেছে। পুলিশ জানিয়েছে, শ্রদ্ধার সঙ্গে এই কমন ফ্রেন্ডের যোগাযোগ ছিল। কিন্তু একটা সময়ের পর থেকে শ্রদ্ধার সঙ্গে আর যোগাযোগ করতে পারেননি তিনি। সেই খবর শ্রদ্ধার বাবার কাছেও তিনিই পৌঁছে দিয়েছিলেন। আফতাবের বয়ানে বিশেষ কিছু অসঙ্গতি মিলেছে। শ্রদ্ধা-আফতাবের ওই বন্ধু সেই মিসিং লিঙ্ককে সম্পূর্ণতা দিতে পারবেন বলেও মনে করছে পুলিশ। যে ধারালো অস্ত্র দিয়ে শ্রদ্ধার দেহ কুচিয়েছিলেন আফতাব সেই অস্ত্রের হদিশ এখনও পাওয়া যায়নি।
নিখুঁত পরিকল্পনামাফিকই এগিয়ে ছিলেন আফতাব। শ্রদ্ধা জীবিত আছেন এই অস্তিত্ব সকলের কাছে তুলে ধরতে তার ফেসবুক অ্যাকাউন্টটিও ব্যবহার করতেন। শ্রদ্ধাকে খুনের ঠিক ১৫ দিন পরেই সেই ফ্ল্যাটেই নতুন বান্ধবীকে নিয়ে আসে আফতাব। ফ্রিজের মধ্যেই ছিল শ্রদ্ধার কাটা দেহ। কিন্তু এমন কোনও অভিব্যক্তি আফতাব কোনোদিনই প্রকাশ করেননি যা নিয়ে কারুর মনে কোনও সন্দেহ তৈরি হত। তদন্তে নেমে পুলিশ জানতে পারে নতুন সঙ্গীকে যখনই দিল্লির ওই ফ্ল্যাটে নিয়ে আসতেন আফতাব, তখনই ফ্রিজার থেকে উধাও হয়ে যেত শ্রদ্ধার টুকরো করে কেটে রাখা শরীর। নতুন বান্ধবীকে নিয়ে ফ্ল্যাটে এলে সেই ফ্রিজার ফাঁকা করে দিতেন। কয়েক ঘণ্টার জন্য ফ্ল্যাটেরই অন্যত্র টুকরো দেহগুলিকে সরিয়ে দিতেন আফতাব।
পুলিশকে দেওয়া চাঞ্চল্যকর বয়ানে আফতাব নির্বিকার চিত্তে জানিয়েছে, বান্ধবী ফ্ল্যাটে আসার আগেই ফ্রিজার থেকে শ্রদ্ধার টুকরো করে কাটা দেহ একটি কাবার্ডে সরিয়ে ফেলতেন। বান্ধবী চলে যাওয়ার পর তা আবার এনে রাখতেন ফ্রিজারে। ফ্রিজারের বাইরে থেকে মাংসের পচা গন্ধ যাতে ঘরে না ছড়ায়, তার জন্য বান্ধবী ফ্ল্যাটে এলে বিভিন্ন ধরনের ধূপ এবং সুগন্ধিও ব্যবহার করতেন।
বার বার বিয়ের জন্য চাপ দেওয়া শ্রদ্ধাকে পরিকল্পনা মাফিক খুন করতে একটুও হাত কাঁপেনি আফতাবের। উল্টে কত নিখুঁতভাবে খুনকে পরিণতি দেওয়া যায়, সেই কাজে নিজেকে ক্রমশই পারদর্শী করে তুলেছিলেন আফতাব।
ইন্টারনেট ঘেঁটে মানবদেহের শব ব্যবচ্ছেদ করে কিভাবে সেই কাটা টুকরো পরিষ্কার করতে হয়, তা শিখে নিয়েছিলেন। কি কেমিক্যাল ব্যবহার করে কিভাবে ঘরে রক্তের দাগ মুছে দেওয়া যায়, তাও সুদক্ষ হাতে সেরেছিলেন আফতাব। পুলিশকে নিজে মুখেই সেই কথা জানিয়েছেন তিনি। আগেই নেওয়া ছিল শেফের প্রশিক্ষণ।
শ্রদ্ধার বাবা বিকাশ মদন ওয়াকারের অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত শুরু করে পুলিশ জানতে পারে ছয়মাস আগে খুন হয়েছে শ্রদ্ধা।
মঙ্গলবার তদন্তের স্বার্থে আফতাব আমিন পুনাওয়ালাকে দিল্লি-গুরগাঁও এক্সপ্রেসওয়ের উপর সেই জঙ্গলে নিয়ে যাওয়া হয়। আফতাবকে নিয়ে দিল্লির সেই সমস্ত জঙ্গলে শ্রদ্ধার কাটা মাথা খোঁজে পুলিশ। পুলিশ জানিয়েছে, আফতাবের মোবাইল ফোনটি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। তা ঘেঁটেই চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে আসছে।
শ্রদ্ধার বাবা জানিয়েছেন, মেয়ের ভিন্ন ধর্মী সম্পর্ক কোনওদিনই মেনে নিতে পারেননি তিনি। মেয়ের সঙ্গে শেষ বার যখন তাঁর দেখা হয়, তখন আফতাবকে নিয়েই মনোমালিন্য হয়েছিল তাঁদের। সেটা ২০২০ সাল। কিছু দিন আগেই মাকে হারায় শ্রদ্ধা। বাবা-মা আলাদাই থাকতেন। শ্রদ্ধা সহ তার ভাই-বোনেরা তা মায়ের কাছে থাকতেন। মেয়েকে বলেছিলেন, অন্য ধর্মের সম্পর্ক কোনও মতেই মেনে নেবেন না তিনি।
শ্রদ্ধাকে বলেছিলেন, যদি এই সম্পর্কে থাকতে হয়, তবে মেয়ে যেন চেনা পরিচিতির গণ্ডির বাইরে চলে যায়। বাবার কথা শুনেই বাড়ি ছেড়ে চলে যায় শ্রদ্ধা। যাওয়ার আগে বাবাকে শ্রদ্ধা জানিয়েছিলেন মেয়েকে যেন চিরদিনের জন্য ভুলে যায় তারা। পরে শ্রদ্ধার বাবা বিকাশ মদন ওয়াকার জানতে পারেন আফতাবের সঙ্গে একসঙ্গে থাকে শ্রদ্ধা। আফতাবকে পছন্দ না করলেও তিনি এর পর আর কিছু বলেননি। পুলিশকে বিকাশ জানিয়েছেন, কলেজে পড়ার সময় অত্যন্ত শান্তশিষ্ট প্রকৃতির ছিল শ্রদ্ধা। কিন্তু স্নাতক হওয়ার ঠিক আগেই হঠাৎ মেয়ে কেমন যেন বদলে যায়। তবে শ্রদ্ধার দায়িত্ববোধ ছিল প্রখর। ওর মা মারা যাওয়ার পর সংসারের কাজ একা হাতে সামলাত। খুব সাহসী ছিল।
২০২১ সালের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত মেয়ের সঙ্গে কথা হত তাঁর। কিন্তু শ্রদ্ধা কখনই তাঁকে আফতাবের অত্যাচারের কথা বলেনি। মেয়ের মৃত্যুর পর তার বন্ধুদের থেকে তিনি জানতে পারছেন, মেয়ের উপরে শারীরিক নির্যাতনের কথা। বন্ধুরা যখন এই অস্বাস্থ্যকর সম্পর্ক থেকে শ্রদ্ধাকে বের হয়ে যেতে বলেছিল, তখনও আফতাবকে ছেড়ে যেতে রাজি ছিল না সে। শ্রদ্ধার সঙ্গে সম্পর্ক থাকাকালীন বহু মেয়ের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছিলেন আফতাব। ডেটিং অ্যাপ থেকেই নতুন নতুন বান্ধবীদের সঙ্গে সম্পর্ক করতেন আফতাব। এই নিয়েও দুজনের মধ্যে অশান্তি চরমে ওঠে।
আফতাবের ফেসবুক প্রোফাইল ঘেঁটে দেখা গিয়েছে, সেখানে ‘উদার’, ‘নারীবাদী’ হিসাবে নিজের সম্পর্কে নিজের একটি ইমেজ তৈরি করেছিলেন আফতাব। এমনকি আফতাব নিজেকে এলজিবিটিকিউ সমর্থক হিসাবেও দেখিয়েছিলেন। ২০১৫ সালে আফতাবের একটি পোস্ট বলছে, কালীপুজোয় বাজি ফাটানো উচিত নয়।
২০১৫ সালেই আফতাবের আরও একটি পোস্টে দেখা যায়, মহিলাদের উপর অ্যাসিড হামলার বিরোধিতা করা হয়েছে।
মেয়ের টুকরো হয়ে জঙ্গলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা দেহ খুঁজতে পুলিশ শ্রদ্ধার বাবা বিকাশ মদন ওয়াকারকে ডেকে পাঠিয়েছে। শ্রদ্ধার বাড়ি ছেড়ে চলে আসার পর মেয়েকে নিয়ে দুশ্চিন্তা ছিল বিকাশের। মেয়ের এই পরিণতি কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না শ্রদ্ধার বাবা ব্যবসায়ী ষাট ষাট ছুঁই ছুঁই প্রৌঢ় বিকাশ মদন ওয়াকার।