নোবেলজয়ী বাঙালি অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ন্যায়বিচারের সাংবিধানিক নীতির সঙ্গে বাস্তবে যা ঘটছে, সেখানে একটা বৈপরীত্য পরিলক্ষিত হচ্ছে। অতিমারির সময় ভোট করা হবে কী হবে না, এই প্রশ্নটাই অবান্তর। কারণ এই দুটির মধ্যে বেছে নেওয়ার বাধ্যবাধকতা দুঃখজনক। অমর্ত্য সেন বিশ্বাস করেন, দক্ষিণ এশিয়ার সমস্ত দেশ এখনও যৌথভাবে অতিমারির মোকাবিলা করতে পারে।
প্রশ্নঃ কীভাবে অতিমারি আপনাকে ও আপনার শিক্ষাকে প্রভাবিত করেছে?
উত্তরঃ অতিমারি আমাকে প্রভাবিত করেছে। আমি ছাত্রদের সরাসরি মুখোমুখি হয়ে শিক্ষাদানে বিশ্বাস করি। কিন্তু এখন আমাকে জুমের সাহায্যে শিক্ষা দিতে হচ্ছে। আমার এটা একেবারেই পছন্দ নয়। এই যে ভার্চুয়াল শিক্ষাদান– এটাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। আমার ক্লাস শুরু হওয়ার কথা সেপ্টেম্বরে। আশা করি ততদিনে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে। আমি আমার ম্যাসাচুসেটের বাড়িতে আটকে পড়ে আছি। আমার ইচ্ছে হয় শান্তিনিকেতনে আমার ছোট বাড়িতে গিয়ে ঘুরে আসি।
প্রশ্নঃ আপনার বইয়ে আপনার শৈশবকে আপনি কীভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। ভ্রমণ, কবীর, রবীন্দ্রনাথ, নদ-নদী কীভাবে আপনাকে প্রভাবিত করেছে। বিশেষ করে আপনার বুদ্ধিজীবী সত্তাকে?
উত্তরঃ শান্তিনিকেতন আমার ব্যক্তি এবং আমার চিন্তাধারাকে যথেষ্টভাবে প্রভাবিত করেছে। শুধু রবীন্দ্র-প্রভাব নয়, বরং আমার সহপাঠীরা আমাকে প্রভাবিত করেছেন। ভারতে স্কুলগুলি শুধু পরীক্ষায় সফল হওয়ার কায়দা শেখায়। আমার ঢাকার স্কুলে (সেন্ট গ্রেগরি) ছাত্রদের পরীক্ষার জন্য খুব ভালোভাবে তৈরি করা হত। কিন্তু শিক্ষার উপর পরীক্ষায় তৈরি হওয়ার প্রভাব আমার জন্য খুব হতাশাজনক ছিল। শান্তিনিকেতনে আমি মুক্তির স্বাদ পাই। পরীক্ষার বাইরে শিক্ষা সম্পর্কে আমার ধারণা গড়ে ওঠে। শান্তিনিকেতনে শিক্ষার পরিবেশ আমার ভালো লাগত। সেখানকার লাইব্রেরি আমাকে আকর্ষণ করত। বিশ্ব সম্পর্কে আমার ধারণা গড়ে উঠেছিল শান্তিনিকেতনে। আমি এটা বুঝতে পারলাম ইউরোপ–আমেরিকা এবং পূর্ব ও পশ্চিম এশিয়ায় সফরে গিয়ে।
প্রশ্নঃ আপনার বইয়ে আপনি লিখেছেন শান্তিনিকেতনে আপনি স্বাধীনতা এবং যুক্তিকে একত্র করে দেখতে লিখেছিলেন?
উত্তরঃ অন্যান্য রাজ্যের চেয়ে বাংলা বেশি সমৃদ্ধ নয়। অন্যান্য জায়গার মতো বাংলার নিজস্ব শক্তি রয়েছে। সৌভাগ্যক্রমে শান্তিনিকেতনের শিক্ষাপদ্ধতি ছাত্রদের মুক্ত চিন্তা করতে শেখায়। কিন্তু শান্তিনিকেতনে আমলাতন্ত্রের প্রবেশের ফলে প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ন্ত্রণ শিক্ষকদের হাত থেকে বেরিয়ে চলে যায় জাতীয় রাজনৈতিক শক্তিগুলির হাতে। বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য নিযুক্ত হলেন প্রধানমন্ত্রী। এতে কোনও আপত্তি ছিল না, যদি প্রধানমন্ত্রী সেখানে স্বাধীন চিন্তাকে উৎসাহ দিতেন। কিন্তু শান্তিনিকেতনে সংকীর্ণ মতবাদ চাপিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ শুরু হল। শান্তিনিকেতনের পতনে কোনও অভিনবত্ব নেই। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুনরুজ্জীবনের কথাই ধরা যাক। এটি একটি মহান বিশ্ববিদ্যালয়। আন্তর্জাতিক মহল থেকে চাপ আসছিল এই বিশ্ববিদ্যালয় ফের চালু করার। কিন্তু যেই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ন্ত্রণ শিক্ষাবিদদের হাত থেকে চলে গেল আমলাতন্ত্রের হাতে তখনই শুরু হল এর অধঃপতন। তারপরেই নালন্দা হয়ে উঠল অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো।
প্রশ্নঃ করোনাকালে ভারতে কি ব্যক্তিগত আয়ের ক্ষেত্রে তারতম্য দেখা গেছে?
উত্তরঃ তারতম্য তো অবশ্যই দেখা গেছে। রোজগার হারিয়েছেন অনেক বেশি মানুষ। বেশি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে গরিব এবং প্রান্তিক মানুষের ক্ষেত্রে। প্রমাণ রয়েছে শ্রেণি বিশেষ এই অতিমারির শিকার হয়েছেন বেশি।
প্রশ্নঃ আপনি কি মনে করেন, বিচারব্যবস্থা ফাদার স্ট্যান স্বামীর জীবন বাঁচাতে ব্যর্থ হয়েছে?
উত্তরঃ এই প্রশ্নের উত্তরে আমি হ্যাঁ বলব। অন্ততঃ বিচারব্যবস্থার জবাবদিহি চাওয়া উচিত কেন তারা নিরাপত্তা দিতে পারেনি। স্ট্যান স্বামী ছিলেন পরোপকারী। তিনি অক্লান্তভাবে গরিব মানুষের সেবা করতেন। সরকার তাঁকে নিরাপত্তা দেওয়ার পরিবর্তে তাঁর জীবনকে বিপদগ্রস্ত করে তুলেছিল আইনের অপব্যবহার করে। তিনি ধীরে ধীরে শারীরিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন। বিচারব্যবস্থা তাঁকে সাহায্য করতেই পারত। এখন এটা ভেবে দেখা দরকার– আমলাতন্ত্রের বাড়াবাড়িকে বিচারব্যবস্থা কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করবে।
প্রশ্নঃ একদিকে ভারত চাইছে ৫ ট্রিলিয়নের অর্থনীতি হতে– অপরদিকে মানুষ ন্যায়বিচার পাচ্ছেন না। এতে কি স্ববিরোধিতা নেই?
উত্তরঃ স্ববিরোধিতার কথা জানি না তবে এই দু’টি বক্তব্যে বৈপরীত্য আছে। সংবিধান যে পথে চলার নির্দেশ দিয়েছে বাস্তবে কিন্তু হচ্ছে উলটোটাই। আমি জানি না সাধারণ মানুষ কি ৫ ট্রিলিয়নের অর্থনীতি চান? হয়তো কিছু লোক চাইতে পারেন। কিন্তু জনতা চায় ন্যায়বিচার।
প্রশ্নঃ আপনি যখন ভারতের দিকে তাকান– তখন কোন দু’টো কিংবা তিনটি জিনিস দেখে আপনি আশান্বিত হন?
উত্তরঃ দু-তিনটি জিনিস নয়– ভারতের ৩৫টি জিনিস দেখে আশার সঞ্চার হয়। আমরা বহু বিষয়ে উন্নতি করতে পারি। যেমন দারিদ্র্য কম করার জন্য যাবতীয় প্রকল্প গ্রহণ করতে পারি। সমাজে অসাম্য দূর করতে অগ্রণী হতে পারি। মত প্রকাশের স্বাধীনতা সুনিশ্চিত করতে পারি। একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে গর্জে উঠতে পারি। ভারতীয় হিসেবে এই কাজগুলি ছাড়াও বহু কাজ রয়েছে যেগুলি করলে ভারত পালটে যাবে। আমি মানুষের জন্য এই আশা পূরণের স্বার্থে যতটুকু সম্ভব কাজ করতে আগ্রহী।