এ হাসান: মণিপুর নিয়ে মুখ খুলেছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী মোদি। তাঁর মুখ-নিসৃত ৩৩ সেকেন্ডের বক্তব্যকে গেরুয়াপন্থীরা প্রচার করছেন, এই তো দেশের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন মণিপুরে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তাঁর বক্তব্য একটি গণতান্ত্রিক, সাংবিধানিক এবং সব নাগরিকের সমমর্যাদার দেশ হিসেবে সারাবিশ্বে ভারতের মুখ উজ্জ্বল করেছে! অস্বীকার করার উপায় নেই, নীরব মোদিজি পার্লামেন্ট অধিবেশনের প্রথম দিনে ৩৩ সেকেন্ডের জন্য জবান খুলেছেন। আর তাতেই গেরুয়া শিবিরে সাধু সাধু রব উঠেছে।
মোদিজি জবান খুলেছেন, না খুলতে বাধ্য হয়েছেন? তা নিয়ে অবশ্য প্রশ্ন রয়েছে। মণিপুরে ৭৭ দিন ধরে রক্তপাত, প্রাণহানি, ঘর জ্বালানো, ধর্ষণ চললেও মোদিজি সেই গুজরাত সহিংসতার মতোই টুঁ শব্দটি করেননি। কেন প্রধানমন্ত্রী এই পরিস্থিতিতে মণিপুরে গেলেন না কিংবা নিদেন একটি কড়া বার্তাও দিলেন না তা অবশ্য রহস্যময়ই থেকে যাবে। কে জানে মণিপুর সম্পর্কে কী ছিল মোদিজির মনে!
বৃহস্পতিবারের বারবেলায় নয়, সকাল সকাল মোদিজি মুখ খুলেছেন। কিংবা বলা যায় খুলতে বাধ্য হয়েছেন। কারণ, মণিপুরের নারকীয় অবস্থার একটি ভিডিয়ো ট্যুইটার ও সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারিত হয়েছে। আর তা রয়টার্স, আল-জাজিরা, বিবিসি প্রভৃতি সংবাদমাধ্যমে বিশ্বজুড়ে প্রচারিত হয়েছে। অবশ্য তাতে ভারতের মুখ উজ্জ্বল হয়েছে কি না, তা ঠিক বুক ঠুকে বলা যাবে না।
ভিডিয়োটি কী? মণিপুরের একটি গ্রামে হত্যাযজ্ঞ চালানোর পর মেইতেইদের বাহিনী দুই খ্রিস্টান কুকি নারীকে গণধর্ষণ করে। তারপর খ্রিস্টান কুকি সম্প্রদায়কে অপমান করার জন্য ওই দুই অসহায় নির্যাতিতা মহিলাকে সম্পূর্ণ উলঙ্গ করে টিটকারি দিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘোরানো হয়। মহাভারতে দুর্যোধন দ্রৌপদীর কাপড় খোলার যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন, তা থেকে দ্রৌপদী রক্ষা পেয়েছিলেন দৈব সাহায্যে। কিন্তু কুকি মহিলাদের সাহায্যে কেউই এগিয়ে আসেনি। ধর্ষক ও নির্যাতনকারীরা বরং নারীত্বের চরম অপমানকে উপভোগ করেছেন।
এই পৈশাচিক ঘটনাটির খবর নাকি মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিং আইবি মারফত তৎক্ষণাৎ পেয়েছিলেন। খবরটি পৌঁছেছিল আমাদের ক্ষমতাশালী গৃহমন্ত্রী অমিত শাহজির কাছে। আর সেক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী মোদিজি জানবেন না, তা হতে পারে না। মোদিজি তবুও ৭৭ দিন ধরে নীবর মোদি হয়ে থাকার পথই বেছে নেন। লোকেরা বলছেন, আর তার প্রমাণও পাওয়া গেছে। মণিপুরে যে মাসের পর মাস ইন্টারনেট বন্ধ রাখা হয়েছিল, তার প্রধান কারণ নাকি এই খবর এবং এই ধরনের অন্যান্য সংবাদ যেন জনসমক্ষে ছড়িয়ে না পড়ে।
তা মোদিজি কী বলেছেন? মোদিজির অমৃত বয়ান হল, এই ঘটনায় ১৪০ কোটি ভারতবাসী লজ্জিত হয়েছেন। মণিপুরের কন্যাদের প্রতি যা হয়েছে তা মাফ করা হবে না। অবশ্যই বলতে হয়, ধন্য মোদিজি, আপনি ধন্য। এই ধরনের একটি বার্তা যদি সহিংসতার প্রথমেই দিতেন, তাহলে হয়তো মণিপুরের অনেক জীবন বাঁচত, সম্পত্তি রক্ষা পেত, সেনাবাহিনী আরও সক্রিয় হত। মোদিজির নীরবতাকে কখনই স্বর্ণময় বলে আখ্যায়িত করা যাবে না। তবু তো মোদিজি মুখ খুলেছেন। ৭৭ দিন পরে আমাদের প্রধানমন্ত্রী তাঁর গণতান্ত্রিক, সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করেছেন। তা না হয় একটু বিলম্বই হল!
তবে মণিপুরের প্রেক্ষাপটটির দিকে একটু নজর ফেরানো যেতে পারে।
মণিপুরে প্রায় তিন মাস ধরে চলছে হত্যাযজ্ঞ, মহিলাদের অপমান ও নির্যাতন, শিশু-নারী হত্যা, ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ, গ্রাম ও জাতি সাফাই অভিযান। হাজারে হাজারে আক্রান্ত ও ভয়ার্ত মানুষ মণিপুরে ঘরবাড়ি ত্যাগ করে মিজোরাম ও অন্য রাজ্যে আশ্রয় নিয়েছেন।
আক্রমণ হচ্ছে মূলত খ্রিস্টান কুকি সম্প্রদায়ের উপর। আর এই আক্রমণে নেতৃত্ব দিচ্ছে হিন্দু মেইতেই সম্প্রদায়ের উগ্রপন্থীরা। উল্লেখ্য, মণিপুরে যে সরকার রয়েছে, তার মুখ্যমন্ত্রী একজন হিন্দু মেইতেই। পুলিশ-প্রশাসনেও মেইতেইদেরই প্রাধান্য। ফলে ব্যাপকভাবে নির্যাতিত হচ্ছেন ভূমিপুত্র কুকি সম্প্রদায়ের নারী-পুরুষ-শিশুরা। বলা যায়, ভারতের একটি ছোট অঙ্গরাজ্য মণিপুরে আইন-শৃঙ্খলা এবং নাগরিকদের সাংবিধানিক অধিকার সম্পূর্ণভাবে ভেঙে পড়েছে এবং বিপর্যস্ত হচ্ছে। বিপর্যস্ত হচ্ছে খ্রিস্টান জনজাতির ধর্মীয় অধিকার। খ্রিস্টান সূত্র থেকে বলা হচ্ছে, ৪০০-রও বেশি চার্চ মণিপুরে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে অথবা লুঠপাট, ভাঙচুর করা হয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে যা করা প্রয়োজন ছিল, তা হল কেন্দ্রীয় সরকারের হস্তক্ষেপ, যাতে নাগরিকদের সংবিধান স্বীকৃত জীবন-সম্পত্তি ও মর্যাদার অধিকার বজায় থাকে। অস্বীকার উপায় নেই, জনাব স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সহিংসতা শুরু হওয়ার বেশ কয়েকদিন পর মণিপুরে গিয়েছিলেন। গিয়েছিলেন সেনাবাহিনীর প্রধান কর্মকর্তারাও। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। অব্যাহতভাবে জারি থেকেছে প্রাণহানি, ধ্বংস ও গুরুতর আহত হওয়ার ঘটনা। বলদর্পী অমিত শাহ মণিপুরে ২ দিন থেকে কি কাজের আন্জাম্ দিলেন, তা অনেকেরই ঠিক বোধগম্য হচ্ছে না। বিজেপির যে ডবল ইঞ্জিন সরকারের প্রবক্তারা কথায় কথায় পশ্চিমবাংলার কেন্দ্রীয় শাসন জারির হুমকি দেন, মণিপুরের ক্ষেত্রে কিন্তু তাঁদের টিকিও দেখা যাচ্ছে না। তাঁদের শ্লোগান, বাংলায় চাই ৩৫৫। আর মণিপুর যেন ২০০২ সালের গুজরাত। সেখানে পুলিশ-প্রশানের মদদে চলে সংখ্যালঘুদের জেনোসাইড বা গণহত্যা, ঘরবাড়ি-সম্পত্তি-ধর্মস্থান ধ্বংস। মিডিয়ার রিপোর্টকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে গুজরাতে অব্যাহত থাকে অবিচার-বেইনসাফি, বাবু বজরঙ্গি ও মায়া কোদনানিদের নৃশংসতা। পেট চিরে গর্ভবতী নারীদের সন্তান বের করে অগ্নিতে নিক্ষেপ, মুসলিম মহিলাদের ধর্ষণ, নারোদা পাটিয়া ও অন্য জায়গায় হত্যার পর কুয়োতে নিক্ষেপ ইত্যাদি ইত্যাদি।
মণিপুরের মতোই শ্রী নরেন্দ্র মোদিজি আর্ত মুসলিম শরণার্থীদের আশ্রয় গ্রহণ করা কোনও উদ্বাস্তু শিবিরে তাদের দেখতেও যাননি। তবে গুজরাতে মোদিজি ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। আর মণিপুরে তিনি দেশের সর্বেসর্বা প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু আচরণে কোনও ফারাক নেই। সেনাবাহিনীকে ডাকা হয়েছিল বহু পরে। কিন্তু তাদের দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। খুনি বাহিনীর সহিংসতার বিরুদ্ধে সেনাকে কোনও পদক্ষেপ নিতে দেওয়া হয়নি। সেখানে মোতায়েন সেনাকর্তা লে. জেনারেল জমিরউদ্দীন শাহ-এর স্মৃতিকথায় তা বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। ‘দ্বিতীয় গুজরাত’ মণিপুরেও সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে ঘটেছে একই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি।
‘সংঘ পরিবারের ল্যাবরেটরি’ বলে কথিত গুজরাতে যেমন দাঙ্গার আগে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে নানা মিথ্যা প্রচারণা ও ঘৃণা ছড়ানো হয়েছিল, মণিপুরেও কিন্তু সেই একই অবস্থা।
সংঘ পরিবার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে খ্রিস্টান ষড়যন্ত্র, খ্রিস্টান রাজ্য গড়ে উঠছে বলে বহু বইপত্র, লিটারেচার বহুদিন ধরে প্রকাশ করে চলেছে। তাদের বক্তব্য, খ্রিস্টানরা আন্তর্জাতিক সহযোগিতায় উত্তর-পূর্বাঞ্চলে একটি খ্রিস্টান রাষ্ট্র গড়ে তোলার চক্রান্ত করেছে। আর এতে সাহায্য করছে, খ্রিস্টান চার্চ, স্কুল ও হাসপাতালগুলির কর্মকর্তারা।
কে জানে মণিপুর তথা উত্তর-পূর্বাঞ্চলে খ্রিস্টান প্রবৃদ্ধির বিরুদ্ধেই একটি মহল ব্যবস্থা নেবে কি না? হয়তো আগামী দিনে তা জানা যেতেও পারে। তবে এখনই যে কথাটি খুব স্পষ্ট, তা হল নাগরিকরা যে ধর্ম, বর্ণ, জাতপাত ও ভাষা মানুষই হোন না কেন তাঁদের পরিপূর্ণ সুরক্ষা দেওয়ার দায়িত্ব ছিল প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদিজি উপর।