আহমদ হাসান: খুব অল্প দিনের মধ্যেই হাওড়ার বাঁকড়ায় মুন্সিডাঙা সরদার পাড়ায় অবস্থিত ‘দ্বীনিয়াত মুয়াল্লিমা কলেজ’ সারাবাংলায় সাড়া ফেলেছে। অথচ এই প্রতিষ্ঠানটির পথ চলা শুরু হয়েছে খুব বেশিদিন নয়। তবে বলতেই হবে, এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি ইসলামি ও আধুনিক শিক্ষার মধ্যে সুন্দর এক সমন্বয় করেছে। আরও স্বীকার করতেই হবে ‘দ্বীনিয়াত মুয়াল্লিমা কলেজ-এ প্রকৃত অর্থেই গড়ে উঠেছে অনুপম এক শিক্ষার পরিবেশ। একদিকে যেমন কর্তৃপক্ষ ও শিক্ষক-শিক্ষিকারা লক্ষ্য অর্জনে নিবেদিত প্রাণ– অন্যদিকে এই প্রতিষ্ঠানে এসে ছাত্রীরাও বুঝতে পেরেছে, এখানে যে শিক্ষা তারা পাবে, তা তাদের একদিকে দুনিয়াবি কাজকর্মে অন্যদিকে আখেরাত অর্জনেও এগিয়ে দেবে অনেকটা।
ইদানীং যাতে ছেলে-মেয়েরা প্রকৃত অর্থে ইসলাম ও মুসলিম জীবনাচরণ শিক্ষতে পারে তার জন্য বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ধরনের প্রচেষ্টা হচ্ছে। যেমন ইংল্যান্ড ও আমেরিকায় শুরু হয়েছে সানডে স্কুল– ছুটির সময় কয়েকদিনের সামার ক্যাম্প ইত্যাদি। সেই হিসেবে ‘দ্বীনিয়াত মুয়াল্লিমা কলেজ’-এর মডেলটিও শুধু বাংলা নয়, ভারতের অন্য প্রদেশেও অনুসৃত হচ্ছে।
মেয়েদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারে সরকারিভাবে নেওয়া হয়েছে নানান পদক্ষেপ। ফলে মেয়েরা স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা শেষ করে দেশের অন্য শহরে কিংবা বিদেশেও গবেষণা বা চাকরি করতে যাচ্ছেন। তবে তুলনামূলকভাবে মুসলিম মহিলাদের অংশগ্রহণ অনেকটাই কম। তাছাড়া উচচ-মাধ্যমিক বা কলেজে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে বিয়ে হয়ে যায় অনেক মেয়ের। তারা আর পড়াশোনার সুযোগ পায় না। অনেকে আবার আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হলেও ইসলামের সঠিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত থেকে যান। সেইসব আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত মুসলিম মহিলাদের দ্বীনের শিক্ষা প্রদান করতে এবং ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে হাওড়ার মুন্সিডাঙা সরদারপাড়ায় গড়ে উঠেছে ‘দ্বীনিয়াত মুয়াল্লিমা কলেজ’ বা ‘ডিএমসি। যা দ্বীন-দুনিয়ার শিক্ষা প্রদানের পাশাপাশি মানবিক গুণসম্পন্ন আদর্শ নাগরিক ও ইমানদার তৈরির দিশা দেখাচ্ছে।
ডিএমসি’র অনন্যতা কোথায়? কর্মকতারা জানাচ্ছেন, এখানে পড়শোনা করতে হলে ন্যূনতম উচ্চমাধ্যমিক পাশ হলেই হবে। ভর্তি হওয়ার জন্য নেই কোনও বয়সের বাধ্যবাধকতা। মা-মেয়ে–ননদের সঙ্গে বাড়ির বউ-মায়েদেরও পড়ার সুযোগ করে দিচ্ছে ডিএমসি। শিক্ষার প্রতি আগ্রহ থাকলেই আপন করে নিতে প্রস্তুত তারা।
কর্তৃপক্ষ জানাচ্ছেন, ডিএমসি’তে পড়ানো হয় কুরআন– হাদিস– আক্কাইদ ও মাসায়েল– ইসলামি তরবিয়ত– স্পোকেন ইংলিশ, স্পোকেন আরবি ইত্যাদি। একইসঙ্গে কম্পিউটার, নিউট্রিশন, হেলথ্ সায়েন্স, হোম ম্যানেজমেন্ট, চাইল্ড সাইকোলজি, টিচিং মেথডজলি পড়ানো হয়। মেন ক্যাম্পাসে আবাসিক ব্যবস্থাপনা-সহ রাজ্যে বর্তমানে ডিএমসির মোট শাখা রয়েছে পাঁচটি (হাওড়া মুন্সিডাঙা আবাসিক এ ছাড়াও রয়েছে অনাবাসিক নিমদিঘি, মেটিয়াবুরুজ, কাটোয়া, গড়পা)।
ইতিমধ্যে ডিএমসি থেকে ১৫৬ জন ছাত্রী পাঠক্রম শেষ করেছেন। তাঁদের মধ্যে ৩১ জন দ্বীনিয়াত মুয়াল্লিমা কলেজে শিক্ষকতার কাজ পেয়েছেন। বাকিদের মধ্যে অনেকেই বাড়ি ফিরে মক্তব ও ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়াচ্ছেন। এই মুহূর্তে ছাত্রী রয়েছেন ১৭৩ জন। বর্তমানে এই কলেজ থেকে দুই বছরের কোর্স সম্পন্ন করেছে তিনটি ব্যাচ। এ বছরও একটি ব্যাচ-এর কোর্স শেষ হতে চলেছে।
প্রতিষ্ঠানের সাধারণ সম্পাদক সেখ হায়দার আলি জানান– হাওড়ার মুন্সিডাঙা সরদার পাড়ায় ২০১৬ সালে অনাবাসিক হিসাবে পথচলা শুরু করে দ্বীনিয়াত মুয়াল্লিমা কলেজ। পরে ২০১৮ সালে আবাসিকে পরিণত হয় প্রতিষ্ঠানটি। তিনি আরও বলেন, আমাদের লক্ষ্য রাজ্যব্যাপী ছড়িয়ে পডYক ডিএমসি-র জ্ঞানের জ্যোতি।
কথা বলছিলাম ডিএমসি থেকে পড়াশোনা শেষ করে এখন শিক্ষকতা করছেন এমন কয়েকজনের সঙ্গে। ডিএমসি থেকে পড়াশোনা করে এখানেই পড়াচ্ছেন বা কোর্স কো-অডিনেটর হয়েছেন তাঁদেরই কয়েকজন হলেন, রুনা লায়লা, নাফিসা খাতুন, তাইয়েবা জুলেখা, সালেহা খাতুন, ফারহিন প্রমুখ।
এদের মধ্যে রুনা লায়লা একজন গৃহবধূ। তিন সন্তানের মা হয়েও ইসলাম সম্পর্কে আরও জ্ঞান অর্জন করতে ডিএমসি’তে ভর্তি হয়েছিলেন তিনি। দ্বীনকে শেখার পাশাপাশি তিনি শিখেছেন কম্পিউটার, হাতের কাজও। তিনি বলেন, আমি আমার পুরনো জীবনের কথা ভাবলে অবাক হয়ে যায়। কোনও দিন স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি যে, আমি একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করব। এর জন্য ডিএমসি কর্তৃপক্ষকে শুকরিয়া জানাই।
নাফিসা খাতুন শোনলেন তাঁর স্কুল জীবনের কথা। উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেছেন তিনি। তারপর খুঁজছিলেন আরও জ্ঞানার্জনের সুযোগ। নাফিসা খাতুনের কথায়, এখানে এসে জীবন বদলে গিয়েছে তাঁর। তাঁর কথায়, ইসলামি শিক্ষায় জ্ঞানার্জন করায় সমাজে ও শ্বশুরবাড়িতেও সম্মান বেড়েছে তাঁর।
তাইয়্যেবা জুলেখা, সালেহা খাতুন ও ফারহিনদের কথায়, আমরা সঠিকভাবে কুরআন পড়তে শিখেছি। আল্লাহ্র ইবাদতের তরিকা যেমন রপ্ত করতে পেরেছি, তেমনি কম্পিউটার, স্পোকেন ইংলিশেও দক্ষতা অর্জন করেছি।
এখানকার ছাত্রীরা বলছেন, শালীন পোশাকে স্টেজে শালীন ড্রামায় অভিনয় করা যায় তা স্বপ্নেও আমরা কল্পনা করতে পারিনি। এখন সকলে মিলে একসঙ্গে ইসলামি সংগীত ও গঠনমূলক নাটকের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলতে পারি নানান বিষয়।
এখানে এইসব বিষয়ের পাশাপাশি শেখানো হয় প্রাথমিক চিকিৎসার খুঁটিনাটি। বাড়িতে হঠাৎ কোনও দুর্ঘটনা কিংবা ব্লাড প্রেসার ও সুগারের হেরফের হলে ছাত্রীরাই প্রাথমিক চিকিৎসা শুরু করে দিতে পারেন। এই প্রশিক্ষণও তাদের দেওয়া হয়।
এ দিকে কর্তৃপক্ষ সবসময় চেষ্টা করছেন, এই কলেজটিকে উন্নত থেকে উন্নততর অবস্থায় নিয়ে যাওয়ার জন্য। বর্তমানে যে ক্যাম্পাস রয়েছে তার পাশেই ১০ কাঠা জমিতে নতুন বিল্ডিং তৈরি হবে। এই মুহূর্তে কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বীকৃতি নেই– তাই সরকারিভাবে ডিগ্রি প্রদানের ব্যবস্থা নেই। আগামী দিনে কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রম মেনে এবং বর্তমান যে সিলেবাস তার সমন্বয়ে কোর্স চালুরও চিন্তাভাবনা রয়েছে কর্তৃপক্ষের। এ বিষয়ে শেখ হায়দার আলি বলেন, আমরা ইতিমধ্যেই আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও নেতাজি মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে প্রাথমিক কথাবার্তা বলেছি। প্রতিষ্ঠানটিকে পুর্ণাঙ্গ কলেজর*পে গড়ে তুলতে সবরকম পদক্ষেপ করা হবে।
ডিএমসি-র কর্মকাণ্ড দেখতে দেশ-বিদেশের বহু বিশিষ্টজন পরিদর্শন করেছেন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন সদ্য প্রয়াত গোলাম আহমাদ মোর্তজা– মাওলানা ইসাহাক মাদানি, অধ্যাপক রেজাউল করিম, মাওলানা সাজ্জাদ নোমানি, আজিজুল হক কাশেমি, কাজী ইয়াসিন প্রমুখ।
এ দিকে এই প্রতিষ্ঠানে নিজের ছেলে-মেয়েকে ভর্তি করানোর জন্য একদিনে যেমন অভিভাবকদের উৎসাহের অন্ত নেই অন্যদিকে ছাত্রীরাও চায় এই ধরনের একটি প্রতিষ্ঠানে যোগ দিয়ে জীবনের পথে এগিয়ে চলতে। তাই ‘দ্বীনিয়াত মুয়াল্লিমা কলেজ’-এ প্রতিদিনই ছাত্রী ভর্তির কোনও সুযোগ আসছে কি না, জানার জন্য ফোন আসে। অনেক অভিভাবক আবার সশরীরে হাজির হন।
কর্তৃপক্ষ জানালেন, সামনেই রয়েছে এই প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়ার দু’টি সুযোগ। তারিখ দু’টি হল ১৮ জুলাই ও ১ আগস্ট। এই প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়ার জন্য আবেদনকারী ছাত্রীরা ওই দু’টি দিন অভিভাবক সহ এসে ভর্তির পরীক্ষা দিতে পারবেন। এই সম্বন্ধে বিশদ জানতে ফোন করতে পারেন শেখ মুরসালিন ৯৭৩২৫৮৩১৯১/৭০০৩৩৮৭৩৩২ নম্বরে।
তথ্য সহযোগিতাঃ আসিফ রেজা আনসারী