পুবের কলম প্রতিবেদক: বিরাট দাপটের সঙ্গে নিজের ‘আইএএস ‘সাম্রাজ্য’ ম্যানেজ করতেন দেবাঞ্জন দেব। প্রতারণার সঙ্গে সঙ্গে নানা জনসেবারও কাজ করতেন এই ফেক আইএএস অফিসার। তবে কি তার এই প্রকাশ্য কর্মকাণ্ডের কথা কেউই জানতে পারেনি,ইতিমধ্যেই কিন্তু মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে দেবাঞ্জন যে ভুয়ো আইএএস– তা তার পরিবার বহু আগে জানতে পেরেছিল। শেষপর্যন্ত পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে তা তারা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন।
মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা এই প্রতারকের বিরুদ্ধে পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কড়া অবস্থান নিয়েছেন। তাকে ‘সন্ত্রাসী’ আখ্যা দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন– তিনি নিজেই এই কেসটির উপর নজর রাখছেন। তদন্ত করে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য মুখ্যমন্ত্রী নিজেই পুলিশ কমিশনারকে কয়েকবার ফোন করেন। ক্ষুব্ধ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বলেছেন– এই ঘটনায় পুলিশ এবং কলকাতা পুরসভা দায়িত্ব এড়াতে পারে না।
দেখা যাচ্ছে– দেবাঞ্জন সম্পর্কে এক বছর তিন মাস আগেই পুলিশের কাছে অভিযোগ এসেছিল। এর অর্থ পুলিশও দেবাঞ্জনের বেআইনি কার্যকলাপের আঁচ পেয়েছিল। কিন্তু পুলিশ তার বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। তাই এই ব্যাপারে বিধাননগর কমিশনারেটের বিরুদ্ধে গাফিলতির আঙুল তোলা যায়।
বিধাননগর পুলিশের কাছে সেই মার্চ ২০২০’তেই সরকারি চাকরি পাইয়ে দেওয়ার ভুয়ো প্রতিশ্রুতি দিয়ে অর্থ আত্মসাৎ করার অভিযোগ দায়ের করা হয়েছিল। কিন্তু ‘একজন আইএএস আধিকারিকের’ বিরুদ্ধে এই ধরনের অভিযোগকে সম্ভবত বিধাননগর কমিশনারেট গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি।
বিষয়টি স্বীকারও করে নিয়েছেন লালবাজারের এক অফিসার। তিনি জানান– আমাদের কাছে প্রমাণ রয়েছে– দেবাঞ্জন দেবের বিরুদ্ধে একটি মৌখিক অভিযোগ করা হয়েছিল। অভিযোগটি ছিল যে– দেবাঞ্জন দেব সরকারি চাকরি দেওয়ার মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে অর্থ হাতিয়েছেন। এই অভিযোগ করা হয়েছিল ইলেকট্রনিক কমপ্লেক্স পুলিশ থানায়। কিন্তু কেন তাকে গ্রেফতার করা হল না– সে সম্পর্কে ওই পুলিশ অফিসার বলেন– তাকে গ্রেফতার করা হয়নি কারণ– আনুষ্ঠানিকভাবে তার বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ জমা দেওয়া হয়নি। বিধাননগর কমিশনারেট থেকে এক সূত্র মিডিয়াকে জানিয়েছে– ওই মৌখিক অভিযোগটি করেছিলেন এক তরুণ। তিনি বলেছিলেন– দেবাঞ্জন দেব নিজেকে কলকাতা পুরসভার একজন আইএএস অফিসার বলে বর্ণনা করে সরকারি চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। দেবাঞ্জন দেব নিজেকে পুরসভার এক জয়েন্ট কমিশনার এবং আইএএস অফিসার বলে পরিচয় দিত। দেবাঞ্জন কোনও অনুমতি ছাড়াই বেশ কয়েকটি কোভিড ভ্যাকসিনেশন ক্যাম্পের আয়োজন করে।
আর কোভিড টিকা বলে যা গ্রহীতাদের দেওয়া হয় তা আসলে কি কোভিড টিকা– না ভেজাল ওষুধ সে সম্পর্কে এখন তদন্ত চলছে। তবে একথা ঠিক– তার ক্যাম্পগুলিতে ‘টিকা’ গ্রহণকারীদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি রয়েছে কি না– তা নিয়ে এখন সমীক্ষা চলছে।
এই ঘটনা জানাজানি হওয়ার পরই হেয়ার স্ট্রিট থানায় দেবাঞ্জনের বিরুদ্ধে প্রতারণা ও জালিয়াতির একটি অভিযোগ জমা পড়েছে। অভিযোগে বলা হয়েছে– দেবাঞ্জন দেব ওই স্টকিস্টের কাছ থেকে এক কোটি কুড়ি লক্ষ টাকার মাস্ক ও অন্য স্যানিটাইজার খরিদ করে। দেবাঞ্জন ওই স্টকিস্টের কাছে নিজেকে পুরসভার ‘প্রভাবশালী আধিকারিক’ হিসেবে প্রতিপন্ন করেছিল। কিন্তু এক কোটি কুড়ি লক্ষ টাকা দিয়ে মাস্ক ইত্যাদি খরিদ করলেও সেই সরবরাহকারীর টাকা দেবাঞ্জন এখনও পরিশোধ করেনি।
এই প্রতারক তার কর্মচারিদের বেতন দিত WBFINCORP নামে একটি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে– যাতে প্রতিয়মান হয় যে– এই বেতন বোধহয় দেওয়া হচ্ছে ওয়েস্ট বেঙ্গল ফিন্যান্স কর্পোরেশন থেকে।
কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে যে– দেবাঞ্জন যে আইএএস নয় এই কথাটি কেন মন্ত্রী বা অন্যান্য উচ্চপদস্থ আধিকারিকরা উপলব্ধি করতে পারলেন না। দেবাঞ্জনের বিরুদ্ধে পুলিশ এখন বিভিন্ন ধারায় মামলা দিয়েছে। আশা করা হচ্ছে– আদালত থেকে এই প্রতারক দৃষ্টান্তমূলক ও কঠোর শাস্তি পাবে।