আহমদ হাসান ইমরান: ক্ষিতিমোহন সেন ছিলেন একজন দূরদৃষ্টি সম্পন্ন পণ্ডিত। যার ছিল সংস্কৃত, বাংলা ও হিন্দিতে অগাধ জ্ঞান। জানা যায়, তিনি ফারসি এবং আরবি ভাষাও জানতেন। ক্ষিতিমোহন সেন সমৃদ্ধ করেছিলেন কবিগুরুর শান্তিনিকেতন ও বিশ্বভারতীকে। তাঁর পাণ্ডিত্য তাঁকে ধারনার গণ্ডিতে আবদ্ধ করেনি। বরং দিয়েছিল ঔদার্য ও স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গি। কলকাতায় তাঁকে নিয়ে একটি বিশেষ প্রয়োজনীয় আলোচনা অনুষ্ঠিত হল প্রতীচীর উদ্যোগে। ক্ষিতিমোহন সেনের সেই বিখ্যাত পুস্তক ‘ভারতের হিন্দু-‘মুসলিম যুক্ত সাধনা’ থেকে বেশ কয়েকটি উদ্ধৃতি দিয়ে বিশ্বজিৎ রায় ধরিয়ে দিলেন আলোচনার মূলসূত্রকে। আর এ সবই অনুষ্ঠিত হল ক্ষিতিমোহন সেনের দৌহিত্র এবং প্রতীচীর চেয়ারম্যান নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেনের উপস্থিতি ও অংশগ্রহণের মাধ্যমে।
এই অনুষ্ঠানের মূল সুরটি ছিল ভারতের দুই প্রধান সম্প্রদায় হিন্দু-মুসলিমের মধ্যে ঐক্য, মুহাব্বত এবং যুগ যুগ ধরে হিন্দু-মুসলিমের সম্মিলিত অবদানেই যে গড়ে উঠেছে এই ভারতীয় উপমহাদেশ, তা তুলে ধরা। বিশেষ করে দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে। আর সে জন্যই দৃষ্টি ফেরাতে হয়েছে ক্ষিতিমোহন সেনের ১৯৪৯ সালে একটি পত্রিকায় প্রকাশিত এই পুস্তক ‘ভারতের হিন্দু-মুসলিম যুক্ত সাধনা’টির দিকে। দেশভাগের সেই প্রেক্ষাপটেও ক্ষিতিমোহন সেন তুলে ধরেছিলেন ভারতের হিন্দু-মুসলিম বা অন্যান্য জাতিদের কথা। আর জোরের সঙ্গে বলেছিলেন,এদের সবাইকেই নিয়ে হচ্ছে ‘এই ভারত’।
ইদানিং আমাদের পশ্চিমবাংলাতেও যে সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প বেশ ছড়িয়েছে তা অনস্বীকার্য। আর হিন্দু-মুসলিম পরস্পরের মধ্যে অপরিচিতির দেওয়াল ক্রমশই আরও বেশি মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে। শাসক শ্রেণি, মিডিয়া এবং শিক্ষিত মহলে এই অন্ধকার সম্ভবত সবথেকে বেশি। তাই অবশ্যই আমাদের অভিনন্দন জানানো উচিত, সাবির আহমেদ ও তাঁর ‘নো ইয়োর নেবার’ আপনার প্রতিবেশীকে জানুন এই উদ্যোগকে। সত্যি তো, আমরা একে অপরকে কতটা জানি। আমরা আমাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি মনে করি এটাই হচ্ছে একমাত্র সংস্কৃতি। সকলেরই এটা মেনে নেওয়া উচিত।
এটা অবশ্য আজকের নয়, সৈয়দ মুজতবা আলি তাঁর প্রতিভা দ্বারা সকলেরই প্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। তিনি বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের আড্ডায় অংশগ্রহণ করতেন। হিন্দু- মুসলিমের কথা উঠলে একবার মুজতবা আলি গৃহকর্তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, সত্যি করে বলতো মামু, তোমার এই বাড়িতে এই আড্ডায় আমি ছাড়া আর ক’জন মুসলিম প্রবেশাধিকার পেয়েছে? মামু আর এ সম্পর্কে কোনও কথা বলেননি। চুপ করে ছিলেন।
দেখা যায়, বিভিন্ন পাড়ায় বা স্কুলের প্রেক্ষাগৃহে সম্প্রীতি নিয়ে যে সমস্ত সভা-সমিতিগুলি হয় তার ৯৫ শতাংশই হয় মুসলিম মহল্লায়। এমনকি যদি বলি ‘নো ইয়োর নেবার’ এর যে প্রোগ্রামগুলি হয় সেগুলিও হয় মুসলিম এলাকায়। কিন্তু বর্তমানে যা হওয়া উচিত, তা হচ্ছে মুসলিম ও খ্রিষ্টান সংখ্যালঘুরা সর্বভারতীয় পর্যায়ে নিরাপত্তার অভাবে ভুগছে। তাদের কৃষ্টি-কালচারকে স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে না। ‘যুক্ত সাধনার’ কথা ভুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
এমনকি কোনও আরবি, ফারসি বা উর্দু থেকে উদ্ধৃত শব্দ ব্যবহার করলেও বিরাট প্রতিবাদ করা হচ্ছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কোনও পাঠ্যপুস্তকে যদি লেখা হয় যে হিন্দুরা বলেন, বাবা, মা, কাকা, খুড়ো, মাসিমা, পিসিমা আর মুসলিমরা বলে থাকেন আব্বা, আম্মু,, চাচা, খালা, ফুফু তাহলে প্রচন্ড প্রতিক্রিয়া হয়। কেন শিশুদের শেখানো হবে আব্বা, আম্মু, চাচা বা খালার মতো মুসলমানী শব্দ। ফলে পাঠ্যবই থেকে ওই চ্যাপ্টারগুলি এই পশ্চিমবাংলাতেই বাদ গেছে। বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যকে এখন অনেক জায়গাতেই লেজ তুলে পালাতে হচ্ছে।
তাই বলব, আজকে বাংলার সংখ্যালগুরু সম্প্রদায়ের মধ্যেই সম্প্রীতি ও যুক্ত সাধনার কথা বেশি করে তুলে ধরতে হবে। প্রতীচীর এই অনুষ্ঠানেও দেখা গেল, যে সমস্ত পড়ুয়ারা বা শিক্ষকরা অমর্ত্য সেনকে প্রশ্ন করার মর্যাদা পেয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে বাঙালি মুসলিম বা খ্রিষ্টান প্রায় নেই বললেই চলে। অথচ বাংলায় বর্তমানে সাড়ে তিন কোটি মুসলিম রয়েছেন। এটাই হচ্ছে লেটেস্ট সরকারি হিসেব। যা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে বিধানসভায় বলেছেন।
তাই আজ ‘যুক্ত সাধনায়’ জোর দিতে হবে, সাধনায় সবাইকে যুক্ত করে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে, যার কথা ক্ষিতিমোহন সেন ও দৌহিত্র অমর্ত্য সেন বলছেন। ভারতকে ফ্যাসিবাদ থেকে রক্ষা করার জন্য এর কোনও বিকল্প নেই। সাবির আহমেদরা ‘নো ইয়োর নেবার’ বলে যে প্রচেষ্টা করে চলেছেন, এই সুযোগে আমি এই উদ্যোগকে মুবারকবাদ জানাচ্ছি।