বিশেষ প্রতিবেদক: ভারতবর্ষে যারা সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে দাঙ্গা করতে চায়, তাদের ঘরবাড়ি, ব্যবসা, সম্পত্তি, দোকানপাট গুঁড়িয়ে দিতে চায়, তারা বোধহয় সহিংসতা না করেই এবার থেকেই উদ্দেশ্য হাসিল করতে পারবে। কারণ, এখন সংখ্যালঘুদের অস্তিত্ব বিনষ্ট করার জন্য এক নয়া হাতিয়ার সামনে এসে গেছে। আর তা হল বুলডোজার। এই বুলডোজার দিয়েই নাগরিকদের রুজিরোজগার-বাসস্থান-শিক্ষাদীক্ষা সব কিছুকেই নিশানা করা সম্ভব হচ্ছে। তাদের বিকাশ শুধু নয়, বিকাশের স্বপ্নকেও চুরমার করে দেওয়ার এই নয়া অস্ত্র বুলডোজার সারা পৃথিবীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।
তবে সারা পৃথিবীতে নাগরিকদের বিরুদ্ধে এই অস্ত্র ব্যবহৃত হয়নি। শুধুমাত্র এই বুলডোজার দিয়ে ভূমিপুত্রদের বাস্তুচ্যুত করা, ঘরবাড়ি বিনষ্ট করা ও উদ্বাস্তুতে পরিণত করার ক্ষেত্রে আর একটিই মাত্র রাষ্ট্রের নিদর্শন ভারতকে উদ্বুদ্ধ করতে পারে। আর দেশটি হল জায়নবাদী ইসরাইল। তারাও লক্ষ লক্ষ ফিলিস্তিনিকে তাদের ভূমি ও ঘরবাড়ি থেকে উৎখাত করে সারা পৃথিবীতে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে এবং এই ফিলিস্তিনিদের এই উৎখাতের কাজ ইসরাইল এখনও সমানে চালিয়ে যাচ্ছে।
এই ‘বুলডোজার রাজনীতি’র শুরু বিজেপি শাসিত রাজ্য উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, গুজরাত এবং অতিঅবশ্যই দেশের রাজধানী দিল্লিতে। দিল্লির পুলিশ এবং পুরসভাগুলির রয়েছে বিজেপির কবজায়। প্রথমে জাহাঙ্গিরপুরীতে রামনবমীতে একটি বেআইনি মিছিলকে কেন্দ্র করে মসজিদের সামনে সংঘর্ষ এবং তারপরে দিল্লির বিজেপির আদেশ গুপ্তার নির্দেশ বা অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে বুলডোজার চলে আসে জাহাঙ্গিরপুরীতে। সকলের চোখের সামনে ভাঙা হতে থাকে মূলত মুসলিমদের দোকানপাট, বাড়িঘর এবং মসজিদেরও সামনের একটি অংশ। সুপ্রিম কোর্ট বিনা নোটিশে এই ধরনের ধ্বংস কাজ বন্ধ করার আদেশ দিলেও আরও দুই ঘণ্টা ধরে চলতে থাকে এই বুলডোজার অভিযান। অসহায় সংখ্যালঘুরা ছিল নীরব দর্শকমাত্র।
সোমবার হঠাৎই তারই পুনরাবৃত্তি হতে যাচ্ছিল শাহীনবাগে। এর আগে যেসব বিজেপি রাজ্যে বুলডোজার চলেছে সেখানে মুসলিমদের বিরুদ্ধে সহিংসতা হয়েছিল। আর তারই সূত্র ধরে পুলিশ প্রহরায় বুলডোজার এসে মুসলিমদের ঘরবাড়ি, দোকানপাট সবকিছুই ভেঙে দিতে থাকে। শাহীনবাগে কিন্তু কোনও সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ হয়নি। তাও হাজির হয় বুলডোজার। বিজেপি নেতার বক্তব্য, এই এলাকায় বাংলাদেশি এবং রোহিঙ্গারা রয়েছে। রয়েছে অবৈধ জমি দখল। তাই তারা ব্যবস্থা নিচ্ছেন। শাহীনবাগ কিছুদিন আগেই বিখ্যাত হয়েছিল সিএএ ও এনআরসি বিরোধী আন্দোলনের জন্য। এই লাগাতার আন্দোলনের খবর ছড়িয়ে পড়েছিল সারাবিশ্বে। এবার কিন্তু শাহীনবাগে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। মুসলিম নারীরা প্রাণ-ভয় তুচ্ছ করে বিরাট সংখ্যায় বুলডোজারের সামনে দাঁড়িয়ে পড়েন। এলাকার আপ সাংসদ আমানুল্লাহ খান বলেন, শাহীনবাগে কোনও অবৈধ দখলদারি নেই। ওই এলাকায় মার্কেটের পাশে একটি অস্থায়ী ঘরে ছিল চুনকাম করার নানা সরঞ্জাম।
আমানুল্লাহ খান নিজে এবং শাহীনবাগ রেসিডেন্টস ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের নেতা মুহাম্মদ সেলিম পুলিশের সামনে তা ভেঙে দেন। সেদিনের মতো উচ্ছেদ বন্ধ হয়। তবে পুলিশ কিন্তু বলছে, তারা উচ্ছেদ অভিযান বন্ধ করবেন না। একই কথা বলেছেন দক্ষিণ দিল্লির বিজেপি মেয়র মুকেশ সুরিয়ান। তিনি বলেন, আমরা সব ব্যবস্থা করেছি। বুলডোজার অবৈধ দখলদারি উচ্ছেদ করবেই। পুরসভার বিজেপি দল যে এ বিষয়ে খুবই দৃঢ় প্রতিজ্ঞ, তা তাঁরা বারবার মিডিয়াকে বলেছেন। আর আধাসামরিক বাহিনীর শত শত জওয়ানকেও শাহীনবাগে নিয়ে আসা হয়েছিল। ভাগ্যক্রমে সাধারণ মানুষের রক্তপাত এড়ানো গেছে। কিন্তু নিজেদের পণ ছাড়েনি বিজেপি নেতৃত্ববৃন্দ। এখন প্রশ্ন একটাই, এই ধরনের কলোনি যা পরে পুরসভা স্বীকৃতি দিয়েছে দিল্লিতে আরও অনেক আছে। আছে স্বীকৃতিহীন বহু কলোনি। কিন্তু শুধুমাত্র মুসলিমদের বস্তিগুলিকেই কেন টার্গেট করা হচ্ছে, তা বুঝতে এখন আর কারোরই বাকি নেই।