নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে এক আলোচনাসভায় অংশগ্রহণ করতে কলকাতা এসেছিলেন বিশিষ্ট লেখক ও প্রাবন্ধিক অধ্যাপক রাম পুনিয়ানি। তিনি একাধারে বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার, আইআইটি বোম্বাইয়ের অধ্যাপক ও মেডিক্যাল অফিসার ছিলেন। দেশের বর্তমান পরিস্থিতি ও উত্তরণের রাস্তা নিয়ে তাঁর একটি একান্ত সাক্ষাৎকার। রাম পুনিয়ানির সঙ্গে কথা বলেন পুবের কলম-এর প্রতিনিধি আসিফ রেজা আনসারী
পুবের কলম: প্রথমেই জানতে চাইব ‘লাভ জিহাদ’ নিয়ে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি কী?
রাম পুনিয়ানি: এটা বিজেপির একটা কাল্পনিক ও বৃহৎ ষড়যন্ত্রমূলক অপপ্রচারের অংশ। আমাদের মনে রাখতে হবে- আরএসএস ও বিজেপি পিতৃতান্ত্রিকতায় বিশ্বাস করে। তাই তারা মুসলিম যুবকদের যেমন সায়েস্তা করতে চাইছে, তেমনি হিন্দু মহিলাদের পছন্দ ও স্বাধীনতা হরণ করার জন্যেই লাভ জিহাদের ছুতো ধরে সমাজে ভয় ধরাতে উঠেপড়ে লেগেছে। এরা শুধু মুসলিমদেরই শত্রু মনে করে না, কমিউনিস্ট, খৃস্টান, দলিত ও বহুত্বাদে বিশ্বাসী মানুষজনকেও শত্রু মনে করে আরএসএস-বিজেপি।
পুবের কলম: জনসংখ্যা বাড়িয়ে মুসলিমরা নাকি ক্ষমতা দখল করবে। এটা নিয়ে কী বলবেন?
রাম পুনিয়ানি: মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধির অপপ্রচারের সঙ্গে জনসংখ্যা বিজ্ঞানের সম্পর্কই নেই। অনেক রাজ্যে দেখা গেছে মুসলিম মহিলাদের প্রজনন হার কম। দেশের সামগ্রিক তথ্যের দিকে দৃষ্টিপাত করলেও দেখতে পাবো, স্বাধীনতার সময় থেকে বর্তমানে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার অনেক কমেছে। হিসাব করতে গেলে আগামী ৩০ বছরে মুসলিম জনসংখ্যা মেরেকেটে ১৮ শতাংশ হতে পারে। ফলে বিজেপি-আরএসএস যা বলছে তা অবৈজ্ঞানিক ও অপপ্রচার ছাড়া কিছুই নয়।
পুবের কলম: প্রধানমন্ত্রীর ‘সবকা সাথ-সবকা বিশ্বাস’-এর বাস্তবতা কতখানি?
রাম পুনিয়ানি: পুরোটাই নাটক। বলতে হয় তাই তিনি বলছেন। যদি সত্যিই ‘সবকা সাথ-সবকা বিশ্বাস’ তাঁর সংকল্প হয়, তাহলে মবলিঞ্চিং, হিজাব ব্যান বা মুসলিমদের সুযোগ-সুবিধা প্রদান নিয়ে চুপ থাকছেন কেন! হিন্দুত্ব লাইনটাই আসল, বাকিসব নকল।
পুবের কলম: দেশের গণতন্ত্র ও বহুত্ববাদ সত্যিই সংকটে?
রাম পুনিয়ানি: নতুন করে এ কথা বলার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। সংবিধান, গণতন্ত্র ও বহুত্ববাদের উপর ভীষণভাবে আঘাত করছে আরএসএস ভাবধারায় পরিচালিত বিজেপি সরকার। কেন্দ্রীয় সব প্রতিষ্ঠানকে নিজেদের আয়ত্বে নিয়ে এসেছে কেন্দ্রের শাসকদল। ইডি, সিবিআই, এনআইএ, এমনকী সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চার কেন্দ্রের পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও নিজেদের ভাবধারা জোর করে চাপিয়ে দিচ্ছে তারা।
পুবের কলম: বিচারব্যবস্থার উপরেও কী নিয়ন্ত্রণ চালাতে চাইছে কেন্দ্র?
রাম পুনিয়ানি: এটা দুর্ভাগ্য যে সংবিধানের উপরেও আঘাত আসছে। বিচারব্যবস্থাকে নিজেদের হাতের মুঠোই আনতে উঠেপড়ে লেগেছে বিজেপি। বিচাররক নিয়োগ থেকে পদোন্নতি, সব ক্ষেত্রেই নাক গলাচ্ছে সরকার। ফলে আগামী দিন গভীর অন্ধকার। সব জায়গাতেই কর্তৃত্ববাদী মনোভাব দেখা যাচ্ছে। সংবিধানকে বাদ দিয়ে মনুবাদ চাপানোর তোড়জোড় চলছে।
পুবের কলম: তাহলে পরিস্থিতি থেকে বের হওয়ার উপায় কী?
রাম পুনিয়ানি: দেখুন বিজেপি ইংরেজদের মতো ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ পলিসি নিয়ে নিজেদের শাসনকালকে চিরস্থায়ী করার চেষ্টা করছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে দেশের অধিকাংশ মানুষ বিজেপিকে সমর্থন করে না। এইখানেই বিজেপিকে সরানোর রাস্তা দেখা যাচ্ছে। এর জন্য আমার মনে হয়, বিরোধীদলগুলিকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। ভোট কাটাকুটির খেলা যাতে না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখাও দরকার বলে মনে হয়।
পুবের কলম: আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভারতের অবস্থান কেমন বলে মনে হয়?
রাম পুনিয়ানি: দেশের অভ্যন্তরে যেভাবে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হচ্ছে, সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মীদের গ্রেফতার ও হয়রানি করা হচ্ছে তার খারাপ প্রভাব তো অবশ্যই পড়ছে। আর এমনিতেই জিডিপি, ক্ষুধাসূচক, ফ্রিডম অফ এক্সপ্রেশন তলানিতে যাচ্ছে, তাতে সরকারের কাজকর্ম নিয়ে একটা বিরূপ প্রভাব তো পড়তে বাধ্য। এ দিকে ব্যবসায়িক কারণে চিনকে কিছুই বলছে না ভারত, আর চিনের সেনারা ভারতীয় ভূখণ্ডে মাঝেমাঝেই প্রবেশ করছে, এলাকা দখল করছে। আমার মনে হয়, কোথাও গিয়ে হিন্দুত্ববাদকে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে আপোস করছে সরকার।
পুবের কলম: ভারত জোড়ো যাত্রা নিয়ে কী বলবেন?
রাম পুনিয়ানি: স্বাধীনতার পর এমন বড় সার্থক র্যালি দেশ দেখেনি। ব্যাপক সাড়া দেখতে পাচ্ছি। সম্প্রতি বেশ কিছু রাজ্যে বিধানসভা ভোট, দেখা যাক কতোটা প্রভাব পড়ে। এখানেও বলব- সংবিধান ও গণতন্ত্র বাঁচাতে বিজেপি বিরোধী শক্তিগুলিকে জোটবদ্ধ হওয়া দরকার। বিরোধীতা এটা না করতে পারলে কম ভোট পেয়েও রাজনৈতিকভাবে লাভবান হবে বিজেপি।