আসিফ রেজা আনসারীঃ কুতুব উদ্দিন মোল্লা একজন বাঙালি বিজ্ঞানী। বর্তমানে ওড়িশার কটকে অবস্থিত জাতীয় ধান গবেষণা সংস্থা বা এনআরআরআই-য়ে কর্মরত। কৃষিজীবী পরিবার থেকেই তাঁর উঠে আসা। তারপর পাড়ি দিয়েছেন একটা সুদীর্ঘপথ। দেশ-বিদেশের নামিদামি সংস্থায় প্রশংসিত তাঁর গবেষণা। পেয়েছেন বেশ কিছু পুরস্কারও। সেই সাফল্যের মুকুটে যুক্ত হল আরও একটি পালক। সম্প্রতি ‘দা প্লানেট সেল’ নামে একটি আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান গবেষণা পত্রিকা কুতুব উদ্দিন মোল্লাকে ফিচার এডিটর সম্মানে সম্মানিত করেছে।
এ বিষয়ে কুতুব উদ্দিন জানান– ‘দা প্লানেট সেল’ প্লান্ট বা উদ্ভিদ সম্পর্কীয় একটি বড় গবেষণা পত্রিকা। এখানে কোন গবেষণাপত্র প্রকাশের আগে সবদিক খুঁটিয়ে দেখা হয়। সম্পাদকমণ্ডলীতে রয়েছেন তাবড় তাবড় বিজ্ঞানীরা। এবার সেই কাজে নিজেকে যুক্ত করতে পারলাম।
প্রসঙ্গত– ২০২২ সালের জন্য বিশ্বের ২৪ জন বিজ্ঞানীর তালিকা প্রকাশিত হয়েছে। তাতে একমাত্র ভারতীয় হিসাবে রয়েছেন কুতুব উদ্দিন মোল্লা। তিনি আমেরিকা– জার্মানি– তাইওয়ান– মেক্সিকো– ব্রিটিশ যুক্তরাজ্যের বিজ্ঞানীদের সঙ্গে সেই তালিকায় স্থান পেয়েছেন।
জানা গিয়েছে– কুতুব উদ্দিন-এর কাজ হবে তরুণ বিজ্ঞানীদের গবেষণা পেপার-এর সারবত্তা খতিয়ে দেখা– তা প্রকাশিত হবে কিনা সে সম্পর্কে প্রধান সম্পাদককে পরামর্শ দেওয়া। কারও গবেষণাপত্র-র কোথাও প্রশ্ন দেখা দিলে– সেগুলিকে ফের রিভিউ করা ও সিনোপসিস রচনা করা। এর জন্য কুতুব উদ্দিন যেমন সাম্মানিক পাবেন– তেমনি সিনোপসিস রচনার জন্য পৃথক রিসার্চ ভ্যালু পাবেন।
প্রসঙ্গত– ২০১৭ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত তিনি আমেরিকায় ছিলেন। সেখানকার নামি ফেলোশিপ ‘ফুলব্রাইট’ নিয়ে পেনসিলভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পোস্ট-ডক্টরেট করেন। সেখানেই জিনোম এডিটিং নিয়ে খুঁটিনাটি রপ্ত করেন। তারপর সেই প্রযুক্তি ধানের উপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন। সেই কাজে সাফল্যের মুখও দেখছেন। আগামিদিনে ধান চাষ পরিবর্তিত আবহাওয়ার মুখে পড়লেও উৎপাদনের উপর বির*প প্রভাব পড়বে না– আশাবাদী বিজ্ঞানী কুতুব। তিনি জানান– গোবিন্দভোগ ধান গাছের সাইজ অনেক বড় হয়– ফলে হালকা ঝড়-বাতাস হলেই পড়ে যায়– স্বাভাবিকভাবেই ফলন মার খায়।
নতুন প্রযুক্তি সেই ক্ষতি আটকাতে পারে। কিভাবে কাজ করবে জিনোম এডিটিং- বিজ্ঞানীর কথায়– আমরা জিনের পরিবর্তন ঘটিয়ে ধান গাছের সাইজ ছোট করে দিচ্ছি– ফলে ঝড়-বাতাসে তা আর পড়ছে না। অন্যদিকে ফসলে পোকামাকড় বা অন্যান্য যে ছত্রাকঘটিত ক্ষতি দেখা দেয়– সেগুলির প্রতিরোধী শক্তি তৈরির চেষ্টা করা হয়। সেই কাজ অনেকটাই সফল। আগামীতে ধান চাষে বড় ধরণের বিপ্লব আসতে পারে। তার জন্য ভারতীয় বিজ্ঞানীরা নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছেন। এমনই আশার বাণী শোনাচ্ছেন এই বাঙালি বিজ্ঞানী।
প্রসঙ্গত– কুতুব উদ্দিন মোল্লার বাড়ি উত্তর ২৪ পরগনার মিনাখাঁ অঞ্চলের জয়গ্রামে। তিনি জয়গ্রাম জানকীনাথ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পড়াশোনা করেন। তারপর ২০০৬ সালে কলকাতার সিটি কলেজ থেকে বোটানি নিয়ে স্নাতক হন। ২০০৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেন ক্যাম্পাস থেকে ২০০৮ সালে এমএসসি করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই ২০১৫ সালে পিএইচডি করে। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং। তিনি অধ্যাপনা ও গবেষণার জন্য বিভিন্ন সংস্থায় কাজ করেছেন। ২০১৪-১৫ সালে নয়াদিল্লির ন্যাশনাল ব্যুরো অফ প্লান্ট জেনেটিক রির্সোস-এ বিজ্ঞানী হিসাবে কাজ করেছেন। বেশ কয়েকজন গবেষক তাঁর অধীনে পিএইচডি করছেন।
শুধু দা প্লানেট সেল নয়– আর তিনটি গবেষণা পত্রিকার রিভিউ এডিটর পদে আছেন কুতুব উদ্দিন মোল্লা। তিনি ২০২০ সালে ইয়ং সায়েন্টিস পুরস্কার পেয়েছিলেন। বাবা ইলিয়াস মোল্লা ও মা সুফিয়া বেগম-এর অক্লান্ত পরিশ্রম ও ত্যাগ না থাকলে কাদা-মাটির রাস্তার ধারে বাড়ি ও চাষবাস নিয়েই হয়ত জীবন কেটে যেত– বিজ্ঞানী হওয়া হয়ে উঠত না। বারবার ছোটবেলায় বিদ্যুৎহীন গ্রামের মধ্যে ছোট্ট একটি বাড়িতে হ্যারিকেনের আলোয় পড়াশোনা করার সময় বাবা-মায়ের রাতজাগা তাকে প্রেরণা দেয়। কুতুব উদ্দিন স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে ঠিক এভাবেই তুলে ধরেন বাল্যকালের কথা।