–
নিজস্ব প্রতিবেদকঃ ভারত একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। ভারতের সংবিধান প্রত্যেক নাগরিককেই জীবন-সম্পত্তি– মর্যাদা ও মতামত প্রকাশের স্বাধীনতার মতো মৌলক অধিকার প্রদান করেছে। পৃথিবীর অন্যান্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মতো ভারতে কোনও কয়েদি-কেও বিনা বিচারে পুলিশ হেফাজতে হত্যা করা বড় অপরাধ বলে গণ্য করা হয়। তবুও কিন্তু মাঝেমধ্যে পুলিশ হেফাজতে হত্যা হয়। ক্ষেত্রবিশেষে সেইসব পুলিশের শাস্তিও হয়। কখনও বা তারা পার পেয়ে যায়। কিন্তু তার সঙ্গে প্রদেশ বা রাজ্যের প্রধান প্রশাসকবৃন্দ অর্থাৎ মুখ্যমন্ত্রী– গৃহমন্ত্রী– আইজি বা ডিআইজি যুক্ত রয়েছেন– এমনটা দেখা যায়নি। কিন্তু এখন গণতান্ত্রিক ভারতে সেটাই ঘটতে দেখা যাচ্ছে। সাম্প্রতিক নজির হিসেবে দু’টি রাজ্যের কথা উল্লেখ করা যায়।
উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ এক হিসেব দিয়ে বলেছেন– মার্চ ২০১৭ সাল থেকে ৫ অক্টোবর ২০২০ সালের মধ্যে উত্তরপ্রদেশের পুলিশ ১২৫ জন কথিত ‘অপরাধী’কে হত্যা এবং ২৬০৭ জনকে গুরুতর আহত করেছে। এই পরিসংখ্যানটি প্রায় এক বছরের পুরনো। এর মধ্যে আরও উত্তরপ্রদেশে এনকাউন্টারে মৃত্যু ঘটেছে। যেসব ‘অপরাধী’ নিহত বা আহত হয়েছে– তাদের পরিবার-পরিজনদের অধিকাংশরা বলছেন– কোনও ‘এনকাউন্টার ডেথ’ হয়নি। বরং পুলিশ ঘরের মধ্যে ঢুকে আমাদের নিরস্ত্র স্বজনদের সরাসরি গুলি করে হত্যা করেছে। মিডিয়াতে যা প্রচার করা হয়েছে তা হচ্ছে পুলিশের একতরফা রিপোর্ট। যোগী রাজ্যে পুলিশ আরও কিছু ব্যক্তিকে হত্যা করেছে যাদের মৃতু্যর ঘটনা বেশ রহস্যময়। এদের সম্পর্কে বলা হচ্ছে– পালাবার সময় এদের গুলি করা ছাড়া পুলিশের কাছে কোনও উপায় ছিল না।
উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ পুলিশ আধিকারিকদের একটি মিটিংয়ে বলেছিলেন– আমার সরকার অপরাধ ও অপরাধীদের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স নীতি’ গ্রহণ করেছে। আর এরপরই পুলিশের হাতে একের পর এক ওই হতাহতের ঘটনা ঘটতে থাকে। মানবাধিকার সংস্থাগুলির মতে– এর মধ্যে দু-একটি ঘটনা হয়তো ‘জেনুইন এনকাউন্টার’ বা প্রকৃতই দু-পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা। কিন্তু ৯৫ শতাংশ ঘটনাই হচ্ছে ‘পুলিশকৃত এনকাউন্টার’।
তবে যোগী আদিত্যনাথকে টেক্কা দিচ্ছেন এক সময়ে অসমের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র সংগঠন ‘আলফা’ ঘনিষ্ঠ ও পরে মূল রাজনীতিতে ফিরে আসা হিমন্ত বিশ্ব শর্মা। তিনি মুখ্যমন্ত্রীর পদ হাসিল করার পরই স্বয়ং নিজেকে প্রধান পুলিশ অধিকর্তা এবং প্রধান বিচারপতি বলে ভাবতে শুরু করেছেন। হিমন্ত বিশ্ব শর্মা স্বয়ং নির্দেশ দিয়েছেন– পুলিশ হেফাজতে থাকা অপরাধীরা পালিয়ে যেতে চেষ্টা করলে এবং বিশেষ করে পুলিশের হাতে থাকা রাইফেল বা অন্য অস্ত্র নিয়ে পালাবার উদ্যোগ নিলেই তাদের বিরুদ্ধে গুলি চালাতে হবে। আর দেখা যাচ্ছে– হিমন্ত বিশ্ব শর্মার এই নির্দেশের পরই সমগ্র অসম জুড়ে এক নয়া প্রবণতা শুরু হয়েছে। দেখা যাচ্ছে– পুলিশ যেদিনই অপরাধী সন্দেহে কাউকে থানায় গ্রেফতার করে আনছে– তারা সেইদিনই পুলিশের হেফাজত থেকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। তার আগে ওই অপরাধী বা অপরাধীবৃন্দ হাত বাঁধা বা হাতকড়া পরানো অবস্থায় থানার ভিতর লকআপেই পুলিশকে আক্রমণ করছে। আর তাদের অস্ত্র-শস্ত্র ছিনিয়ে নিয়ে পালাবার জন্য দৌড় দিচ্ছে। অগত্যা কি আর করা! মুখ্যমন্ত্রী (যিনি পুলিশ মন্ত্রী) তিনি তো পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছেন– নিরাপত্তা বাহিনীর অস্ত্র-শস্ত্র ছিনিয়ে নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেই সরাসরি গুলি করতে হবে। যাকে বলা যায় ‘শ্যুট টু কিল’। ১০ মে হিমন্ত বিশ্ব শর্মা মুখ্যমন্ত্রী পদে শপথগ্রহণ করেন। আর তারপর থেকে থানার মধ্যেই পুলিশি হেফাজতে থাকা ২৩ জন ‘গ্রেফতারকৃতকে’ পুলিশ গুলি করেছে। গুলিতে আহত ২৩ জনের মধ্যে ৫ জন নিহত হয়েছে। আর বাকিরা গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে জীবন-মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছে। তা পুলিশ কেন এদের গ্রেফতার করেছিল, এদের বিরুদ্ধে অভিযোগ হচ্ছে– গরু পাচার– ধর্ষণ– খুন– নেশাদ্রব্য বিক্রি– ডাকাতি ইত্যাদি। এই ২৩ জন ছাড়াও গত দু’মাসে ১০ জন জঙ্গিকে পুলিশ হত্যা করেছে। স্বাভাবিকভাবেই অসমের বুদ্ধিজীবী ও মানবাধিকার কমিশন এই পুলিশি হত্যার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে। অসম মানবাধিকার কমিশন কারও অভিযোগ ছাড়াই এই ঘটনাগুলিকে তদন্তের জন্য নিজেরাই গ্রহণ করেছে ও নোটিশ পাঠিয়েছে। কিন্তু হিমন্ত বিশ্ব শর্মা পিছিয়ে যাওয়ার লোক নন। ১৪ জুলাই তিনি বিধানসভায় বলেছেন– সরকার অপরাধীদের বিরুদ্ধে তার ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি’ চালিয়ে যাবে। তিনি আরও বলেন– পুলিশের প্রতি আমার সুস্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে– আপনারা আইনের মধ্যে থেকে যেকোনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারেন এবং অসম সরকার আপনাদের সব ধরনের সুরক্ষা দেবে।
পরবর্তী কিস্তি আগামীকাল