পুবের কলম, ওয়েবডেস্কঃ যেকোনও দেশে আইনের শাসন থাকা খুব জরুরি। আর তা না হলে মানবাধিকার– গণতন্ত্র– মত প্রকাশের স্বাধীনতা– বিচার বিভাগের মর্যাদা কোনও কিছুই নিরাপদ থাকে না। নিরাপদ থাকে না মানুষের জান-মাল ও মর্যাদা।
সুখের বিষয়– ভারতের সংবিধান মানুষকে জীবন-সম্পত্তি সহ সব ধরনের অধিকারের নিশ্চয়তা দিয়েছে। কিন্তু তার উল্লঙ্ঘনও অনেক সময় দেখতে পাওয়া যায়। যেমন যোগী-রাজ্য উত্তরপ্রদেশে পুলিশের এনকাউন্টারে বহু মানুষ রহস্যময়ভাবে নিহত হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ ও তাঁর পুলিশ আধিকারিকদের বক্তব্য ছিল– এরা সকলে ক্রিমিনাল। তাই তাদের গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। এনকাউন্টার করে মেরে ফেলতে হয়েছে কিংবা এরা পুলিশের উপর গুলি চালিয়ে পালানোর চেষ্টা করেছিল– তাই…।
এনকাউন্টারে মৃত ব্যক্তিদের আত্মীয়-স্বজন এবং মানবাধিকার সংস্থাগুলি এর তীব্র নিন্দা করেছে। তাদের বক্তব্য– প্রাণ নেওয়ার অধিকার পুলিশের নেই। ভারতীয় সংবিধান প্রত্যেক অপরাধীকে আদালতে সোপর্দ করার কথা বলেছে। কিন্তু শাসকদের সব সময় সংবিধান মেনে চলতে হবে এমন দায়বদ্ধতা নেই। অনেক সময় শাসকরাই দণ্ড এবং মুণ্ডের কর্তা হয়ে ওঠেন।
যোগী আদিত্যনাথের কাছ থেকে মনে হয় সবক হাসিল করেছেন অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শরমা। তিনিও পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছেন– যারা (অপরাধীরা) পালাতে চেষ্টা করবে তাদেরকে গুলি করে হত্যা করতে হবে। তিনি পুলিশের এনকাউন্টারগুলিকে সমর্থন করেন।
আর মুখ্যমন্ত্রীর কাছ থেকে জোরাল সমর্থন পেয়ে অসমের পুলিশও গুলি চালিয়ে হত্যা করার খেলায় নেমে পড়েছে। অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই অসমের পুলিশ জুন মাসের ১ তারিখ থেকে ৮ তারিখের মধ্যে ১৪টি ঘটনায় গুলি চালিয়েছে। তাদের বক্তব্য– পুলিশের হেফাজতে থাকা অভিযুক্তরা পালাবার চেষ্টা করেছে। আর তাই অভিযুক্তদের উপর গুলি চালাতে হয়েছে। এই গুলি চালানোর ফলে বেশ কয়েকজন আহত হয়েছে। আর দু’জনের মৃত্যু হয়েছে।
সব মিলিয়ে পুলিশের গুলিতে আপাতত তিন জনের মৃত্যু হয়েছে। লক্ষণীয় তিনজনই হচ্ছে সংখ্যালঘু। এর মধ্যে দু’জন হচ্ছে মুসলিম আর একজন হচ্ছে শিখ সম্প্রদায়ের। পুলিশের সেই একই বক্তব্য– এরা পালাবার চেষ্টা করছিল কিংবা পুলিশের বন্দুক ছিনতাই করে পালাতে যাচ্ছিল। তাই তাদের উপর গুলি চালিয়ে হতাহত করতে হয়েছে।
এ দিকে কাদের উপর পুলিশকে কঠোর হতে হবে তারও একটি তালিকা অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শরমা পুলিশকে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন– যদি কোনও অভিযুক্ত পুলিশের বন্দুক বা রিভলভার ছিনতাই করে পালিয়ে যায় অথবা এমনিতেই পালাবার চেষ্টা করে তাদেরকে গুলি করতে হবে। এ ছাড়া ধর্ষকদেরও প্রথমে পায়ে গুলি করতে হবে।
এর মধ্যে অসমের মুখ্যমন্ত্রীকে প্রশ্ন করা হয় যে– এভাবে আসামিদের উপর পুলিশের গুলি চালনা একটি প্যাটার্ন বা রীতিতে পরিণত হচ্ছে। হিমন্ত উত্তর দেন– এভাবে গুলি করা অবশ্যই প্যাটার্নে পরিণত হবে। যদি অভিযুক্তরা ক্রিমিনাল হয় এবং তারা পুলিশের হেফাজত থেকে পালাতে চেষ্টা করে তাহলে গুলি করা হবে।
অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শরমা রাজ্য পুলিশকে বলেছেন– গরু পাচারকারীদের বিরুদ্ধেও পুলিশকে খুবই কঠোর হতে হবে। তিনি আরও বলেন– এদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেওয়ারও প্রয়োজন নেই। যেকোনও উপায়ে তাদের ধরতে হবে। কারণ– আমাদের গরুসমূহকে রক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব। তিনি আরও যোগ করেন– একটি গরু আমাদের কাছে একটি দেবতার সমান। পরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে হিমন্ত একটু নরম হন। তিনি বলেন– পুলিশের এভাবে এনকাউন্টারে কাউকে মারার অধিকার নেই। গণতন্ত্রে অপরাধকে আইনের মাধ্যমে মোকাবিলা করতে হয়– এনকাউন্টার করে নয়। কিন্তু যখন অন্য উপায় থাকে না– তখন এনকাউন্টার করা ছাড়া ভিন্ন পথ আর কি হতে পারে।
মে মাস থেকে অসমের পুলিশ হেফাজতে ১২ জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। এদের সম্পর্কে বলা হয়– এরা নাকি পালাবার চেষ্টা করছিল। পুলিশের গুলিতে আরও বেশ কিছু মানুষ হতাহত হয়েছে। জুন ও চলতি জুলাই মাসে অসমে পুলিশের গুলিতে নিহতের সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। পুলিশি রেকর্ড থেকে দেখা যাচ্ছে– কুনওয়ালদীপ সিং সিধুকে কার্বি আলংয়ে একজন পুলিশ অফিসারের বন্দুক ছিনতাই করে পালানোর সময় গুলি করে হত্যা করা হয়। এ ছাড়া ১ জুন পুলিশের গুলিতে ৩ জন নিহত ও ১৫ জন আহত হয়। এ ছাড়া গরু চোর সন্দেহে ২ জনকে গুলি করা হয়। গুলি চালিয়ে অন্য ২ জনকে ধর্ষণের অভিযোগে এবং বাকি ২ জনকে ড্রাগ পাচারকারী হিসেবে গ্রেফতার করা হয়। আর এরা পুলিশ হেফাজত থেকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে তাদের উপর গুলি চালানো হয় বলে পুলিশের ভাষ্য।
পর্যবেক্ষকরা বলছেন– হঠাৎই দেখা যাচ্ছে– অসমে পুলিশ হেফাজত থেকে বন্দুক ছিনতাই করে পালানোর চেষ্টা করা’ আসামির সংখ্যা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে।
মানবাধিকার সংগঠনগুলি বলছে– এভাবে পুলিশ ধৃত ব্যক্তিদের গুলি করতে পারে না। আর পুলিশ হেফাজতে হ্যান্ডকাপ পরানো থাকলে কী করে বন্দিরা পুলিশের বন্দুক ছিনতাই করে পালানোর চেষ্টা করছে– তা নিয়েও ঘোরতর সন্দেহ রয়েছে।
উল্লেখ্য– বিজেপি শাসিত উত্তরপ্রদেশের যোগী রাজ্যেও পুলিশের দ্বারা এই ধরনের বহু এনকাউন্টারে বেশ কিছু মানুষকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই এদের হত্যা বিষয় পুলিশ যে চার্জশিট দিয়েছে তাতে ‘খুনি’ কোনও পুলিশ অফিসারের বিচার হয়নি। হিমন্তের অসমেও দেখা যাচ্ছে– যোগী রাজ্যের মতো এখানেও একই পথে হাঁটা হচ্ছে। অসমে আলফা বা অন্য জঙ্গি সংগঠনগুলি বিদ্রোহের পথে হাঁটলেও কখনও পুলিশ হেফাজতে তাদের হত্যা করা হয়নি।