অনেক দিন পর সংখ্যালঘু ও মাদ্রাসা উন্নয়ন বিভাগের দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে একজন পূর্ণমন্ত্রীর উপর। তাঁর ঐকান্তিকতার হাত ধরে বিশ্ববিদ্যালয় দ্রুত সামনের পায়ে হাঁটবে– এটা খুবই স্বাভাবিক। এমন মাহেন্দ্রক্ষণকে কিছুতেই ব্যর্থ হতে দেওয়া যায় না। তেমন হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে আমরা সম্ভাব্য সব পক্ষই অপরাধী হয়ে থাকব। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস– সদ্য দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী জনাব গোলাম রব্বানি সাহেব এই সমস্যা কাটিয়ে উঠবেন। এ সম্পর্কে লিখেছেন সাইফুল্লা
বেশ কিছু দিন সুস্থভাবে চলার পর নতুন করে সংকটের মধ্যে পড়েছে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু কেন এই সংকট- সংকটের কারণ মোটেই সুস্পষ্ট নয়। বাতাসে অনেক কথাই ভাসমান রয়েছে। এর মধ্যে কোনটি সারকথা আর কোনটি অকথা তা নির্ণয় করা যাচ্ছে না। একপক্ষ বলছেন– সরকার নাকি চাইছেন না বর্তমান উপাচার্য তাঁর পদে বহাল থাকুন, তিনি অবিলম্বে পদত্যাগ করুন এমনটাই নাকি সরকার পক্ষের ইচ্ছা। অন্যপক্ষ বলছেন– একটা শ্রেণি তাদের কায়েমি স্বার্থকে চরিতার্থ করার জন্য সরকারকে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করতে চাইছে। এমন বিপ্রতীপতার মধ্যে পড়ে রীতিমতো সংকটে পড়েছে আলিয়া পরিবার।
কিছুদিনের মধ্যে শুরু হতে যাচ্ছে চলতি সেমেস্টারের পরীক্ষা, চলছে সমাবর্তন ও ন্যাকের প্রস্তুতি। অর্থাৎ রীতিমতো সাজোসাজো রব। এরই মধ্যে কারও কারও পক্ষ থেকে উপাচার্য মহাশয়কে পদত্যাগ করতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। সংবাদটা স্বাভাবিকভাবেই বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্দরমহলে ছড়িয়ে পড়েছে এবং ঘনীভূত হয়েছে উদ্বেগের মেঘ। বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার তাদের সাধারণ বোধ-বুদ্ধি দিয়ে কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছেন না– এভাবে একজন উপাচার্য মহাশয়কে পদত্যাগ করতে বলা যায় কি-না। যদি সত্যিই তিনি এমন বক্তব্যের প্রেক্ষিতে পদত্যাগ করেন– তবে যে অস্বস্তিকর দৃষ্টান্ত তৈরি হবে তার ফলাফল শেষাবধি শুধু আলিয়া নয়– সব বিশ্ববিদ্যালয়েরই ক্ষতি করবে। এতে কি আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মান ও ভবিষ্যৎ বিপন্ন হবে না!
এখনও পর্যন্ত আমাদের সমাজে যেসব প্রতিষ্ঠানকে ঘিরে মূল্যবোধের প্রদীপ প্রজ্জ্বলিত রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় তার মধ্যে অন্যতম। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেক্ষিতে উপাচার্যের সম্মান সবার উপরে। সেই উপাচার্যই যদি অসম্মানিত হন– তবে বিশ্ববিদ্যালয় ও তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কারও সম্মানই সুরক্ষিত থাকে না। তাছাড়া– আরও কথা আছে। আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ঠিক আর পাঁচটা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো নয়। এর সামাজিক দায়বদ্ধতার সীমানা অনেক দূর পর্যন্ত প্রসারিত। উত্তর-স্বাধীনতা পর্বে এপার বাংলার মুসলমান সমাজে যে গভীর সংকট ও পশ্চাৎপদ অবস্থা তৈরি হয়েছে– তার নিরাময়ের লক্ষ্যে প্রবল সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র হিসাবে গড়ে তোলার চেষ্টা করা হচ্ছে এই বিশ্ববিদ্যালয়কে। আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাফল্য-ব্যর্থতার উপর কেবল বাংলার মুসলমান সমাজের নয়— পূর্ব-ভারতের সংখ্যালঘু সমাজের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। এমন অবস্থায় সম্ভাব্য সব পক্ষকে অনেক বেশি দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে। এই মুহূর্তে যার বিশেষ অভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে।
একটা বিষয় নিয়ে বেশ কিছুদিন যাবৎ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অত্যন্ত অস্বস্তির মধ্যে রয়েছেন বলে জানা গিয়েছে। কয়েক বছর আগে কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে একশো কোটি টাকা দেওয়া হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়কে, ভোকেশনাল শিক্ষা প্রসারের লক্ষ্যে। বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ম মেনে কয়েকটি সংস্থাকে দিয়ে এই শিক্ষণের ব্যবস্থা করেছিল। কিন্তু সেই ব্যবস্থা সেভাবে কার্যকর হয়নি। দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা তাদের কর্তব্যে অবহেলা করে। ফলত– বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে চুক্তির শর্ত অনুসারে উক্ত সংস্থার প্রাপ্য প্রদানে সমস্যা তৈরি হয়। এদিকে উদ্ভূত এই সমস্যার প্রেক্ষিতে কেউ কেউ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর চেষ্টা করছেন বলে শোনা যাচ্ছে। তারা নাকি চাইছেন– বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অবিলম্বে ওই টাকা উক্ত সংস্থাসমূহকে প্রদান করুন। টাকার অঙ্কটা হাজার হাজার বা লক্ষ লক্ষ নয়– কোটি কোটি। কাজেই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে সিরিয়াস হতেই হচ্ছে। মূল সমস্যাটা নাকি তৈরি হয়েছে এখান থেকেই।
সমস্যার স্বরূপ যাই হোক– তার সমাধান-সূত্র কিন্তু সন্ধান করতে হবে নিয়ম মেনে– নিয়মের মধ্যে থেকে। এখানে কোনওরকম বেনিয়ম করা হলে তার ভার বর্তাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর, কোনও কোম্পানি বা আধিকারিক বা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব শেষপর্যন্ত এর এতটুকুও দায়ভার বহন করবেন না। এই অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করতেই হবে। এই সতর্কতা কারও কারও না-পছন্দবা শিরঃপীড়ার কারণ হলে কিছু করার নেই। সেক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দুঃখপ্রকাশ করতে পারেন মাত্র।
যে মহলটি থেকে উপাচার্য মহাশয়কে পদত্যাগ করতে বলা হচ্ছে– তারা তাদের দিকের যুক্তি হিসাবে উপাচার্যের প্রশাসনিক ব্যর্থতাকে তুলে ধরতে চাইছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে— দফতর থেকে টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে– কিন্তু সেই টাকা খরচ করা হচ্ছে না— নির্দিষ্ট সময়ের পরে ফেরত যাচ্ছে অধিকাংশ টাকা। এমন বক্তব্যের যে ভিত্তি আছে, তা বলা বাহুল্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকাঠামোগত উন্নয়ন সত্যিই প্রায় স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। বরাদ্দ টাকার অনেকটাই খরচ করা হয়নি। এসব সত্য। কিন্তু শেষ সত্য কি? বোধহয় নয়। এক্ষেত্রে সত্যের উল্টো একটা দিকও রয়েছে এবং সেদিকের দর্পণে চোখ রাখলে রীতিমতো বিব্রত হতে হয় বলে অনেকে মনে করছেন।
গত দুই বছরে ন্যূনতম পরিচালন ব্যয় ব্যতীত দফতরের দিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়কে অতিরিক্ত কিছুই দেওয়া হয়নি। উপরন্তু কিছু আধিকারিকের পক্ষ থেকে এমন কিছু আচরণ করা হয়েছে যা হতাশাব্যঞ্জক। আধিকারিকদের প্রশাসনিক সক্ষমতা ও একজন উপাচার্যের সামাজিক সম্মান দুই-ই সমান গুরুত্বপূর্ণ। এই দুই-এর মধ্যে সামঞ্জস্য করতেই হয়। না হলে সুস্বাস্থ্য বজায় থাকে না। সমস্যা হল– এক্ষেত্রে সুস্বাস্থ্য বজায় থাকা না থাকার উপর সংশ্লিষ্ট আধিকারিকদের কিছু এসে যায় না। তাঁরা আজ এই দফতরে রয়েছেন তো কাল অন্য দফতরের দায়িত্বপ্রাপ্ত হবেন। তারপর যথাসময়ে আগুন নিভে যাবে। মাঝখান থেকে অপূরণীয় ক্ষতি হবে প্রতিষ্ঠানের। আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে এই ক্ষতি ইতিমধ্যেই প্রকট হয়ে উঠেছে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য– যে টাকা ব্যয় হয়নি— তার দায় সম্পূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর বর্তায় না। নিয়ম মেনে টাকা খরচ করার জন্য ন্যূনতম যতটা সময় পাওয়া দরকার অনেক ক্ষেত্রে সেই সময় পাওয়া যায়নি। টাকা এসেছে অনেক পরে এবং নির্ধারিত সময় অতিক্রান্ত হতেই তা ফেরত চলে গিয়েছে। কোনওরকম অতিরিক্ত সময় পাওয়া যায়নি। অনেক ক্ষেত্রে এমন হয়েছে– নিয়ম অনুসারে পার্চেজ অর্ডার বেরিয়ে গিয়েছে এবং সেই অনুসারে সংশ্লিষ্ট কোম্পানি তাদের প্রোডাক্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছে দিয়েছেন— এদিকে প্রাপ্য অর্থ তাদের হাতে তুলে দেওয়া যায়নি। টাকা ফেরত দেওয়ার আগে বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক মন্ত্রককে জানানো হয়েছিল এবং তাঁরা বলেছিলেন– তেমন হলে ওই টাকা নতুন করে দিয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু তাঁরা কথা রাখেননি। এখন অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে– পাওনাদাররা প্রতিদিন তাগাদা দিচ্ছেন আর বিশ্ববিদ্যালয়-কর্তৃপক্ষ মাথা নিচু করে তাঁদের অসহায়ত্বের কথা নিবেদন করছেন। প্রশ্ন হল– যাঁরা টাকা খরচ করতে না পারার জন্য কর্তৃপক্ষকে অভিযুক্ত করছেন তারা এটা কী করলেন! বছর ঘুরে গিয়েছে পাওনাদারদের টাকা পরিশোধ করা যায়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের মাথা হেঁট হয়েছে ও হচ্ছে! এই অসম্মানের দায় কার?
এখন যা পরিস্থিতি তার বিপরীত কিছু হওয়া একান্ত প্রত্যাশিত ছিল। অনেক দিন পর সংখ্যালঘু ও মাদ্রাসা উন্নয়ন বিভাগের দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে একজন স্বাধীন দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীর উপর। তাঁর ঐকান্তিকতার হাত ধরে বিশ্ববিদ্যালয় দ্রুত সামনের পায়ে হাঁটবে– এটা খুবই স্বাভাবিক। বস্তুত বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রীবৃদ্ধি– জাতির স্বপ্নপূরণ এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। এমন মাহেন্দ্রক্ষণকে কিছুতেই ব্যর্থ হতে দেওয়া যায় না। তেমন হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে অপরাধী হয়ে থাকবেন সম্ভাব্য সব পক্ষ। এখন যে সমস্যা তৈরি হয়েছে তার সমাধানের পথ সম্পূর্ণ মসৃণ না হলেও খুব বন্ধুর নয়। যদি সত্যিই সরকারপক্ষ উপাচার্য মহাশয়ের পদত্যাগ চান— তবে সম্মানজনক পদ্ধতি অনুসরণ করে তা কার্যকর করা জরুরি। উপযুক্ত অভিযোগের প্রেক্ষিতে কারণ দর্শানোর নির্দেশ দিয়ে কার্যকরী পদক্ষেপের সূচনা করা যেতে পারে। তা না করে আজ যদি উপাচার্যকে যেমন-তেমন ভাবে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়— তবে কেবল উপাচার্যের আসনকে নয়– অসম্মান করা হয় গণতান্ত্রিক পরিকাঠামোকেই— যা আমাদের কারোরই কাম্য হতে পারে না।
এই ডামাডোলের মধ্যে একটা প্রশ্ন কিন্তু ফিরে ফিরে মনের কোণে উঁকি দিচ্ছে! সত্যিই কী এমন কোনও গুরুতর অভিযোগ বর্তমান উপাচার্যের বিরুদ্ধে রয়েছে যার প্রেক্ষিতে তাঁকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা যেতে পারে, তেমন কোনও অভিযোগের কথা কিন্তুù শোনা যাচ্ছে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্দরমহল থেকে উপাচার্যের পদত্যাগ দাবি করা হয়নি— শিক্ষক– অশিক্ষক কর্মচারী– ছাত্রছাত্রী কোনওপক্ষ থেকেই নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যারা প্রত্যক্ষভাবে সম্পৃক্ত তারা কেউ এমন দাবি করেননি— বৃহত্তর সমাজের পক্ষ থেকেও কোনও গণ-আন্দোলন দানা বাঁধেনি— তা হলে কেন!
যারা মনে করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নতি স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে– তাদের ভাবনার সঙ্গে সহমত পোষণ করছেন না বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেকেই। পঠন-পাঠন ও গবেষণার ক্ষেত্রে বর্তমান উপাচার্যের কার্যকালে যথেষ্ট অগ্রগতি ঘটেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পডYয়ারা কর্মক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কাঙ্ক্ষিত সংখ্যায়। পরিকাঠামোগত উন্নতি ব্যাহত হয়েছে নিশ্চয়ই। কিন্তু প্রশ্ন হল– গত চার বছরে পরিকাঠমোগত উন্নতির জন্য কত টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে, শেষ দুই বছরের সাপেক্ষে সংখ্যাটা শূন্যের কাছাকাছি রয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে। এই অবস্থায় পরিকাঠামোর প্রশ্নকে সামনে এনে উপাচার্যকে অভিযুক্ত করা কতটা নৈতিক! এদিকে যদি প্রশ্ন করা হয়– কেন এই টাকা পাওয়া গেল না, তবে সম্ভাব্য যে উত্তর উঠে আসে তা অত্যন্ত পীড়াদায়ক। প্রশাসনিক প্রতিবন্ধকতা এখানে প্রায় ভবিতব্যের রূপ প্রাপ্ত হয়েছে। পিছিয়ে পড়া একটি সমাজের সামাজিক অগ্রগতির লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে একটি বিশ্ববিদ্যালয়– যে বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নতির জন্য মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী একশো শতাংশ আন্তরিক— তার উন্নয়ন প্রশাসনিক প্রতিবন্ধকতার ফাঁসে ফেঁসে যাচ্ছে— দিনের পর দিন অব্যবহৃত থেকে যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বরাদ্দকৃত টাকা, এটাকে দুর্ভাগ্যজনক বললেও কম বলা হয়।
এক্ষেত্রে আরও দুঃসহ যন্ত্রণার কথা এই যে– কয়েকজন ব্যক্তি যারা বহিরাগত অথবা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত তারা এই করোনা পরিস্থিতিজনিত বাধ্যবাধকতাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্গনে প্রবেশ করে উপাচার্য মহাশয়ের পদত্যাগ দাবি করছে। তারা কোন অধিকারে একাজ করতে পারে! বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসমাজ নিশ্চয়ই তাদের দাবি-দাওয়া জানাতে পারে– প্রয়োজনে উপাচার্যের পদত্যাগও দাবি করতে পারে— কিন্তু তারও পদ্ধতি আছে। সংখ্যাধিক্য সেখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। গুটিকয়েক ছাত্রের ইচ্ছা হলেই তারা উপাচার্য মহাশয়ের পদত্যাগ দাবি করতে পারে না। আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে অন্যত্র এমন উদ্ভূত ঘটনা ঘটে বলে আমাদের জানা নেই। এদের অবস্থান ও কার্যকলাপ সুস্থ চেতনা প্রসারে প্রবল প্রতিবন্ধকতা স্বরূপ।
সব দেখে শুনে যেন কেবলই মনে হচ্ছে– আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও এর সঙ্গে সম্পৃক্ত সমাজ এখনও নাবালকত্বের দশা অতিক্রম করতে পারেননি। পাড়ার ক্লাব– গ্রামের একটা মাদ্রাসা বা ওই ধরনের সামাজিক প্রতিষ্ঠানের অতিরিক্ত বিশেষ কিছু হিসাবে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়কে জ্ঞান করতে পারছেন না অনেকেই। ব্যর্থতা রয়েছে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষেরই। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কয়েকজন বহিরাগতের প্রবেশ রুখতে পারছেন না– তাদের অবৈধ প্রবেশের প্রেক্ষিতে গ্রহণ করতে পারছেন না কোনও আইনি পদক্ষেপ। পাড়ার ক্লাবে বা আর সব সাধারণ প্রতিষ্ঠানে মাতব্বরি করতে অভ্যস্ত যারা– তারা বিশ্ববিদ্যালয়কেও তাদের অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র বলে মনে করছেন। সম্ভাব্য সব পক্ষ নিজ নিজ ক্ষেত্রে ক্ষমতার বাহাদুরি দেখিয়ে আত্মতৃপ্ত হতে চাইছেন। কিন্তু তাঁরা ভুলে যাচ্ছেন– এই আত্মতৃপ্তি কুয়াশার মতোই ক্ষণস্থায়ী। এমন আত্মতৃপ্তির জাল বিস্তার করে প্রকারান্তরে সেই সমাজের ভবিষ্যতকেই অন্ধকারাচ্ছন্ন করা হচ্ছে– যে সমাজের উন্নতির লক্ষ্যে তাঁরা দায়িত্বশীলতা দেখাচ্ছেন।
একটা বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হয় ইউজিসি ও সংশ্লিষ্ট রাজ্যের উচ্চশিক্ষা দফতরের নির্দেশিকা অনুসারে। এই প্রেক্ষিতে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে খুবই সমস্যা তৈরি হয়েছে। আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়কে অন্যসব সংস্থার সঙ্গে একাকার করে দেখা উচিত নয়। ইউজিসি ও রাজ্য উচ্চশিক্ষা দফতরের কার্যক্রম সম্পর্কে বিশেষভাবে ওয়াকিবহাল এমন আধিকারিকদের সমন্বয়ে কোনও স্বতন্ত্র সেল তৈরি করা হয়নি আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিষয়সমূহ দেখভালের জন্য। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের দৈনন্দিন কার্যকলাপ রীতিমতো ব্যাহত হচ্ছে। উচ্চশিক্ষা দফতর থেকে কোনও নির্দেশিকা জারি হলে তার ‘ম্যাচিং অর্ডার’ প্রায়শ সময়মতো বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছাচ্ছে না। ফাইল চলাচলে অস্বাভাবিক রকমের বিলম্ব হচ্ছে। রয়েছে আরও অনেক সমস্যা। এদিকে কিছু আধিকারিক এমন কিছু কিছু বিষয়ে প্রশ্ন তুলছেন— যা কিছুটা হাস্যকরও। বিশ্ববিদ্যালয়কে উচ্চ দাম দিয়ে এমন অনেক বই কিনতে হয় যা হয়তো বা বছরে একবার ব্যবহৃত হয় বা তাও হয় না। এমন অবস্থায় কোন বই,কতবার ব্যবহৃত হয়েছে তার হিসাব দিতে যাওয়া খুবই বিড়ম্বনার। অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গিয়েছে– কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘রেয়ার সেকশনে’ বছরে হয়তো দুই-একজন গবেষকের পদার্পণ হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তারপরেও কয়েকজন কর্মী সহযোগে সম্পূর্ণ ‘সেটআপকে’ অদ্যাবধি রেখেছেন। কাজেই গোটা বিষয়টাকে খুব গভীরভাবে তলিয়ে দেখতে হবে। মারকাটারি করে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে ভুল হবে। বিশ্ববিদ্যালয় অবশ্যই অন্য অনেক প্রতিষ্ঠানের থেকে অনেকটা আলাদা— এটা কিছুতেই ভুলে গেলে চলবে না।
পরিস্থিতি এখন যে জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে তাতে যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবিষ্যৎকে সুরক্ষিত রাখতে হয় তবে সকল পক্ষকে এগিয়ে এসে কঠোর হাতে ঘটনাক্রমকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এ ব্যাপারে অভিভাবক হিসাবে মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করা যেতে পারে। আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিষয়ে মুখ্যমন্ত্রী মহাশয়ার আন্তùরিকতা প্রশ্নাতীত। তবে শুধু সরকারের উপর দায়ভার অর্পণ করে অন্যদের হাত গুটিয়ে বসে থাকলে চলবে না। প্রত্যেককেই তার নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করতে হবে। বিশেষ করে ক্রিয়াশীল হতে হবে সুধী সমাজকে। প্রয়োজনে তাদেরকেই এগিয়ে এসে ধরতে হবে হাল। তবে সুশীল সমাজের একজন এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকার সুবাদে আমি বলব– আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়কে যে কোনও মূল্যে অশান্তির হাত থেকে রক্ষা করা প্রয়োজন। সদ্য সংখ্যালঘু উন্নয়ন ও মাদ্রাসা মন্ত্রকের দায়িত্ব নিয়েছেন জনাব গোলাম রব্বানি সাহেব। তাঁর কাছে আমাদের আবেদন– আপনার বিশেষ উদ্যোগ সংখ্যালঘু চরিত্রের এই বিশ্ববিদ্যালয়টিকে সঠিক পথে চলতে ও শিক্ষাক্ষেত্রে নবজাগরণ ঘটাতে সাহায্য করবে।
লেখকঃ বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ
(মতামত লেখকের নিজস্ব)