ইমামা খাতুনঃ আল-আমীন মিশনের প্রাক্তনীদের সংগঠন ‘আল-আমীন প্রত্যয় ফাউন্ডেশন’-এর উদ্যোগে রবিবার আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্ক সার্কাস ক্যাম্পাসের অডিটোরিয়ামে একটি বিশেষ সভার আয়োজন করা হয়। পবিত্র কুরআন তেলাওয়াতের মধ্য দিয়ে এদিনের সভা অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠানের প্রতীকী লোগো উন্মোচনের মাধ্যমে আল-আমীন প্রত্যয় ফাউন্ডেশেনের আনুষ্ঠানিক পথ চলা শুরু হয় এদিন। অনগ্রসর শ্রেণির শিক্ষা, আর্থসামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্য নিয়েই তারা যাত্রা শুরু করেছেন বলে জানান প্রতিষ্ঠানের প্রেসিডেন্ট ডা. হাম্মাদুর রহমান। এছাড়া আল-আমীনের প্রাক্তনী হিসেবে তাদের পথ চলার বিস্তারিত আবেগঘন বিবরণ দেন ইঞ্জিনিয়ার আবদুল মাবুদ মণ্ডল।
আল-আমীন মিশনের সাধারণ সম্পাদক এম নুরুল ইসলাম বলেন, পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানরা যখন শিক্ষাক্ষেত্রে জেগে উঠছিল, তখন তাঁদেরকে স্বপ্ন দেখাতে ও নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছে এই প্রতিষ্ঠান। মাত্র কয়েকজনকে নিয়ে শুরু হওয়া আল-আমীন মিশনের বর্তমান শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ২৫ হাজার। এদিন তিনি আরও বলেন, মানুষের মতো মানুষ হতে গেলে নবী সা.-র সুন্নাহ্ ও আল্লাহর আদেশ মেনে চলতে হবে।
এদিন তিনি প্রত্যয় ফাউন্ডেশনের প্রাক্তনীদের সামনে বলেন, তারা যেভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষের উন্নয়নের লক্ষ্যে পথ চলা শুরু করেছে, তার প্রয়োজন রয়েছে। তিনি বলেন, কেউ যদি মানবসেবার কাজে পিছিয়ে যায়, তাহলে তাকে আল-আমীনের ছাত্র বলতে খারাপ লাগে। যারা কাজ করে তাদের সামনে এই ধরনের পরিস্থিতি আসা স্বাভাবিক। জীবনে কোনও কাজই ছোট নয়। তিনি মনে করেন, জীবনের পথে এগিয়ে যাওয়ার জন্য সমস্ত কাজেই মনোনিবেশ করতে হবে সমানভাবে। তিনি আরও বলেন, মরহুম মাওলানা আবুল কাশেম সিদ্দিকির কাছে তিনি শিখেছেন কোনও কাজই ছোট নয়। মাওলানা সপ্তাহে একদিন নিজ হাতে শৌচাগার পরিষ্কার করতেন। তিনিও এই শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ হয়েছেন। তিনি বলেন, মুসলিমরা শুধু নিতে আসেনি সমাজ ও মানবতাকে তাদের দিতে হবে। একাত্তরের পর বাংলায় শিক্ষা বিস্তারের অন্যতম পথিকৃৎ জনাব নুরুল ইসলাম বলেন, তিনি চান আল-আমীনের ছাত্ররাও যেন রামকৃষ্ণ মিশনের পড়ুয়াদের মতো দেশের বিভিন্ন স্তরে শীর্ষস্থানে পৌঁছাতে পারে। ৩৭ বছর পেরিয়ে আল-আমীন এখন তাদের প্রতিষ্ঠানগুলি সব সম্প্রদায়ের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ার আশা রাখে।
সাবেক সাংসদ ও পুবের কলম-এর সম্পাদক আহমদ হাসান ইমরান বলেন, প্রত্যয় ফাউন্ডেশনে ২০০২ সালের ব্যাচের আল-আমীনের ছাত্ররা মানুষের সেবা ও পরিবেশ রক্ষার যে কাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করল, তা এক ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত। ইমরান বলেন, এপার বাংলায় মুসলিমদের যে শিকড় রয়েছে, তা মুসলিম ছেলেমেয়েরাই ভুলে যাচ্ছে, অন্যদের তো কথাই নেই।
এ প্রসঙ্গে তিনি কয়েকজন বিখ্যাত ব্যক্তির অবদান সংক্ষিপ্তভাবে তুলে ধরেন। এরা হচ্ছেন সৈয়দ সামসুল হুদা, বেগম রোকেয়া, শের-ই-বাংলা ফজলুল হক, ডা. হাসান সোহরাওয়ার্দী, স্যার আজিজুল হক প্রমুখ। এছাড়া ইমরান ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের বহু আগে আল্লাহর নবী সা.-এর সময় যিনি যুদ্ধক্ষেত্রেও ক্যাম্প করে নার্সের কাজ করেছিলেন সেই রুফাইদা আল-আসলামিয়া-র নজির তুলে ধরেন।
ইমরান আল-আমীনের সঙ্গে পুবের কলম পত্রিকা (মাসিক সাপ্তাহিক ও দৈনিক)-এর নিবিড় সম্পর্কের কথা তুলে ধরেন। বলেন, সেই সূচনাকাল থেকেই কলম পত্রিকা সমাজের স্বার্থে জনাব নুরুল ইসলাম সাহেবের প্রচেষ্টার কথা এবং আল-আমীন ও তার পড়ুয়াদের সাফল্য, সমস্যার বিষয় লিখে এসেছে। ইমরান নুরুল ইসলাম সাহেব ও তাঁর সহযোগীদের নিরলস প্রচেষ্টার কথা উল্লেখ করেন। তিনি অন্য বক্তাদের সমর্থন করে বলেন, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা প্রশাসকরা সমাজে বিশেষ প্রভাব রাখেন।
তিনি এ প্রসঙ্গে এসএসকেএম-এর অবসরপ্রাপ্ত চিকিৎসক ডা. ডি ঘোষ ও বেলভিউ-র ডা. রাহুল জৈন-এর দায়বদ্ধতা এবং রোগী ও তাদের পরিবারের প্রতি সুব্যবহারের কথা উল্লেখ করেন। তিনি আরও বলেন, বর্তমানে পশ্চিমবাংলায় নতুন করে এক মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্ম হয়েছে।
এ জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য, মিডিয়া, ব্যবসা ও চাকরির ক্ষেত্রে নজর দিতে হবে। তিনি আল-আমীনের মডেলে যে অসংখ্য মিশন স্কুল গড়ে উঠেছে এবং মেয়েরাও শিক্ষায় যথেষ্ট পরিমাণে এগিয়ে এসেছে, সেই উদ্যোগকে অভিনন্দিত করেন।
অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি তথা মিশনের সহ-প্রতিষ্ঠাতা মারুফ আজম বলেন, প্রত্যয় ফাউন্ডেশন সমাজের পিছিয়ে পড়া দরিদ্র, অসহায় মানুষদের জন্য যে পদক্ষেপ নিয়েছে, তা প্রশংসনীয়। তিনি আরও বলেন, বিজ্ঞান দিয়ে মানুষ গড়া যায় না। কুরআন-হাদিস দিয়ে আদর্শ মানুষ গড়া যায়। সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের গণিতের অধ্যাপক ড. রবিউল ইসলাম বলেন, আল-আমীন মিশনের ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে যে ঈমানের যে বীজ বপন করা হয়েছে, তাই হচ্ছে সাফল্যের অন্যতম মাপকাঠি।
প্রতীচী-র সাবির আহমেদ বলেন, ৭১জন সফল ব্যক্তিত্ব এখানে এসেছেন। এত সফল ব্যক্তিত্ব আমি বাংলাদেশে দেখেছি, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে এই প্রথম দেখলাম। আধিকারিক সামসুর রহমান বলেন, বাঙালি হিন্দু-মুসলিমের মধ্যে খাওয়া-দাওয়া, ভাষা ও চিন্তার মিল রয়েছে বলে এখনও এখানে সাম্প্রদায়িকতা ততটা শক্তিশালী হয়নি। সবাইকে নিয়ে কাজ করতে হবে।
আমানত ফাউন্ডেশনের প্রধান ও সমাজসেবী শাহ আলম জানান, সংখ্যালঘুদের শিক্ষার পাশাপাশি স্কিল ডেভেলপমেন্টের ক্ষেত্রেও মনোযোগ দিতে হবে। তিনি বলেন, মুসলিমদের প্রাইমারি শিক্ষাতে বিশেষ জোর দিতে হবে।
ডা. হাম্মাদুর রহমান জানান, গ্রামের দারিদ্র ও নিম্নবিত্ত মানুষকে আমি খুব কাছ থেকে উপলব্ধি করেছি। তাই পিছিয়ে পড়া মানুষদের সহায়তা করতেই ‘প্রত্যয়’-এর সূচনা। এদিনের সভায় আইনজীবী মাসুদ করিম, অধ্যাপক আয়াতুল্লাহ ফারুক, শেখ হাফিজুর রহমানসহ বিশিষ্টজনেরা উপস্থিত ছিলেন ও বক্তব্য রাখেন।