বিশেষ প্রতিবেদক: নমঃশূদ্র তথা মতুয়াদের মন জয় করতে সিএএ-র মাধ্যমে নাগরিকত্ব দেওয়ার প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি ছড়িয়ে যাচ্ছেন বিজেপির নেতা থেকে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা। দিন কয়েক আগে বাংলায় এসে এই প্রতিশ্রুতির কথা শুনিয়ে গেলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। কিন্তু বাস্তবে যে বিজেপি সরকার নমঃশূদ্রদের পাশে নেই, তার অগণিত উদাহরণ রয়েছে অসমে। তার সাম্প্রতিকতম নজির ৮৩ বছরের আকলরানি নমঃশূদ্রদের প্রতি দুই দশকের হেনস্থা। নাগরিকত্বের ফাঁদে পড়ে দশ বছর আগে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিলেন আকলরানির তরুণ দিনমজুর ছেলে অর্জুন নমঃশূদ্র। আকলরানি একা লড়াই চালিয়ে অবশেষে যুদ্ধ জয় করলেন। অর্জুন নমঃশূদ্র ভারতীয়। তাঁর মা আকলরানি নমঃশূদ্র ভারতীয়। অর্জুনের বোন অঞ্জলি নমঃশূদ্র ভারতীয়।
২২ বছর শুনানির পর বৃহস্পতিবার এই রায় দিলেন শিলচরের ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালের সদস্য-বিচারক ধর্মানন্দ দেব। তার পরে ধরা গলায় ৮৩ বছরের আকলরানির প্রশ্ন, ‘আমরা তো ভারতীয় ছিলাম, ভারতীয়ই আছি। তবে এত বছর ধরে আমাদের হেনস্থা করা হল কেন?
এনআরসি নিয়ে যখন তুমুল চর্চা, কাছাড় জেলার কাটিগড়া থানার হরিটিকর গ্রামের গরিব দিনমজুর অর্জুন নমঃশূদ্র তাঁর মাকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘আমাদের কোনও সমস্যা হবে না তো? আশ্বাস দিতেন মা, সেই ১৯৬৫ সাল থেকে ভোট দিচ্ছি আমি। কীসের সমস্যা?
তারপরও একদিন সন্দেহভাজন বিদেশি নোটিশ ধরিয়ে দিয়ে গেল সরকারি পেয়াদা, ‘অর্জুন নমঃশূদ্র বিদেশি’। শুরু হয় অর্জুনের দৌড়ঝাঁপ। দিনমজুর করে, আদালতে হাজিরা উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সম্পত্তিও বিক্রি করে দিতে হয়। তাঁকে পুলিশ তুলে নিয়ে গিয়ে জেলে ভরলে বৃদ্ধা মা ও ছোট বোনের কী হবে? হেনস্থা জেলখানায অর্থ খরচ— এক অনিশ্চিত জীবন। এই আতঙ্কে সবকিছু থেকে রেহাই পেতে আত্মঘাতী হলেন তরুণ দিনমজুর অর্জুন। সেটা ২০১২ সালের ৮ জুন।
২০১৪ সালে নির্বাচনী প্রচারে শিলচরে জনসভায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এই অর্জুন নমঃশূদ্র কথা উল্লেখ করেছিলেন। খোঁজ খবর করে অসমের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনোয়াল অর্জুনের বাড়িতে গিয়ে দেখা করেছিলেন অর্জুনের মা আকলরানির সঙ্গে। আশ্বাস দিয়েছিলেন, বিজেপি সরকার তাদের পাশে আছে।
কিন্তু আশ্বাসই সার। তারপরে প্রতিদিন সংকট বেড়েছে ওই নমঃশূদ্র পরিবারে। দু’বেলা দু’মুঠো খাবারও জুটছিল না। কেউ নেই পাশে। ছেলের আত্মহত্যার পর রাষ্ট্রের সন্দেহের নজর পরে ওই পরিবারটির উপর। ‘সত্যিই বিদেশ’! ‘বিদেশি সন্দেহে নোটিশ যায় ৮৩ বছরের বৃদ্ধা আকলরানির নামেও। কিন্তু ছেলের পথ না বেছে আইনি লড়াইয়ে নামলেন অশীতিপর মা। নিজের নাগরিকত্বের মর্যাদা তো বটেই, যে কারণে ছেলেটা অকালে মরল— সেই অর্জুনও যে ভারতীয়, সেটা প্রমাণ করাও দায় সেই অসম লড়াইয়ের।
মামলা জয়ের পর আকলরানি মামলার উদাহরণ টেনে বলেন, ২০০০ সালে এক পুলিশ অফিসারের সন্দেহ হয় বাংলাভাষী অর্জুন আদতে বাংলাদেশি। কোনও তথ্য-প্রমাণ ছাড়া ওই পুলিশ রিপোর্ট লিখে দেন, ১৯৭১-এর পরে ভারতে এসেছেন অর্জুন। সেই রিপোর্টের জেরে মামলা শুরু। তিনি নিজে বা অন্য কোনও পুলিশ কখনও আকলরানির কাছে কোনও নথি দেখতে চাননি। ২০০০ সালের ওই মামলা আইএমডি ট্রাইব্যুনাল হয়ে ২০১১ সালে ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে যায়। অথচ এ বিষয়ে বিন্দু বিসর্গ জানতে পারেননি যাঁদের নামে মামলা চলছে সেই অর্জুন ও তার মা আকলরানি। হঠাৎ একদিন নোটিশ— অর্জুন বিদেশি।
আকলরানির পক্ষে ট্রাইব্যুনালে সওয়াল করেন শিলচরের চার আইনজীবী। তাঁরা বিদেশি সন্দেহের গোটা প্রক্রিয়াটিকে দোষারোপ করে বলেন, পুলিশের খামখেয়ালিপনার কারণে অর্জুনের মতো বহু মানুষকে অকালে চলে যেতে হয়েছে। বহু পরিবার চরম হেনস্থার শিকার। অবশেষে ট্রাইব্যুনাল আকলরানিকে ভারতীয় হিসাবে ঘোষণা করেন। বৃদ্ধা আকলরানির আক্ষেপ, প্রতিশ্রুতি দিয়েও তাদের পাশে এসে দাঁড়ায়নি বিজেপি সরকার। বরং সরকারের পুলিশই তাদের অকারণে চরম হেনস্থার মুখে ঠেলে দিল।