ইনামুল হক, বারাসত: পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের ‘নকশী কাঁথার মাঠ’ এক চিরন্তন গ্রামীণ কাব্য আলেখ্য। যার মধ্যে প্রেমিক রূপাইয়ের শোকে বিরহিনী সাজুর একদিন মৃত্যু হলে তার কবরে মেলে দেওয়া হয় তারই বিরহের আলেখ্য আঁকা নকশী কাঁথাখানি। গ্রামীণ বাংলার ঐতিহ্যবাহী সেই নকশীকাঁথা বর্তমান প্রজন্মের কাছে যেন অলীক বস্তু। যান্ত্রিক সভ্যতায় এখন মানুষের সখ সৌখিনতার ধরন পাল্টে যাওয়ায় হাতে আঁকা সুচ-সুতোর কারুকাজ অনেকসময় মূল্য পায়না। তবু আজও গ্রাম বাংলার অনেক মেয়েরা এই নকশি কাঁথার কাজ করে জীবিকার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। একপ্রকার অবহেলা অনাদরে দিন কাটান এইসব গ্রামীণ সুচি শিল্পীরা। শহরের ঝাঁ চকচকে বিপনিগুলোতে কাঁথা জাতীয় হস্তশিল্প শোভা পেলেও মলিন হয়ে থাকে শিল্পীদের জীবন। মধ্য স্বত্ত্বভোগী ফড়েরা নকশী কাঁথা নিয়ে ব্যবসা করলেও আর্থিক দৈন্যতায় ভোগেন গ্রামীন সুচি শিল্পীরা। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় কেউ কেউ পুরস্কৃত হলেও অনেক সময়ই ভালো কাজের সঠিক মূল্যায়ন হয় না এবং তাদেরকে উৎসাহিত করার মতো পাশে দাঁড়ায় না কেউ। এই আক্ষেপ রাজ্য স্তরের পুরস্কৃত সূচীশিল্পী জোহর আলী মল্লিকের। তাঁর কথায় এই সব মহিলা সুচি শিল্পীদের দুঃখকে ভাগ করে নিতে এবং তাদের পাশে দাঁড়িয়ে একজন সুচি শিল্পী হিসাবে তাদের কর্ম উদ্যোগকে ধরে রাখতে এই অভিনব সূচি শিল্প প্রদর্শন ও প্রতিযোগিতার আয়োজন। রবিবার বারাসাতের ছোট জাগুলিয়ার বড়া গ্রামে এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে বিভিন্ন গ্রাম থেকে আসেন মহিলা সুচি শিল্পীরা। তাদের সুচি শিল্প, নকশি কাঁথা প্রদর্শনীর পাশাপাশি সেগুলো বিশিষ্টজনদের বিচারে পুরস্কৃত হয়।
এই প্রতিযোগিতায় সাজেদা বিবি, শিপ্রা নন্দী, মমতাজ বিবিরা যেমন পুরস্কৃত হয়ে শংসাপত্র পেলেন সেইসঙ্গে আর্থিক অনুদান পেয়েও খুশি হলেন তারা। সূচি শিল্পী শিপ্রা নন্দীর কন্যা জানালেন, আমার মা নকশীকাঁথার কাজ করতেন। তিনি অসুস্থ। জোহর আলী বাবুর আহবানে মায়ের হাতের কাজ নিয়েই এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে এসেছি। বলাবাহুল্য, গত কয়েক বছর ধরে গ্রাম বাংলার অবহেলিত সুচি শিল্পীদের নিয়ে এইসব কর্মকান্ড করে আসছেন জোহর আলী মল্লিক। তাঁর এই উদ্যোগের ভূয়সী প্রশংসা করলেন এদিনের অনুষ্ঠানে উপস্থিত বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী ও অধ্যাপক ড. বাসুদেব মন্ডল। তিনি জোহর আলীর শিল্পীসত্তার পূর্ণ বিকাশের বিভিন্ন নমুনা তার আর্ট গ্যালারি ঘুরে দেখেন। বাসুদেব মণ্ডল বলেন, জোহর আলী যে একজন বড় মাপের শিল্পী এবং সেই শিল্পীর স্বীকৃতি না দেওয়া হলে সে অপমান কেবল তার নয়, এ অপমান এলাকার মানুষেরও। তিনি স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ দেন।
জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত শিক্ষক ড. নিরঞ্জন বন্দোপাধ্যায় বলেন, বাংলার সুপ্রাচীন এই শিল্পকে ধরে রাখতে মা বোনসহ সকলে এগিয়ে আসুন। বেঁচে থাকবে নকশী কাঁথা। এতে আমাদের জাতি গৌরবান্বিত হবে। এদিন অন্যতম অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ভারত সরকারের টেক্সটাইল মন্ত্রকের অধীন উন্নয়ন কমিশনার (হস্তশিল্প) তথা হ্যান্ডিক্রাফট সার্ভিস সেন্টারের আধিকারিক স্নেহাংশু শেখর দাস। তিনি বলেন, যেকোন সৃজনশীল শিল্প ভালোবেসে করলে অবশ্যই তাঁর স্বীকৃতি পাওয়া যায়। জোহর আলী বাবু দু’ ধরনেরর কাজ করেন। একটি মহিলাদের হাতে তৈরি বাণিজ্যিক কাজ। আরেকটি তার একান্ত নিজস্ব ভাবনা-চিন্তার সৃজনধর্মী কাজ। তবে অর্থের বিনিময়ে কোন শিল্পের মূল্যায়ন করা যায় না। এই ধরনের হস্তশিল্পের যথেষ্ট বাজার রয়েছে। সব স্তরেই পুরস্কারের ব্যবস্থাও রয়েছে। পরিকল্পিতভাবে এই কাজে যারা এগিয়ে আসছে তারা অনেক সুবিধা পাচ্ছেন।
বিধান নগর পুলিশ কমিশনারেটের অ্যাসিস্ট্যান্ট পুলিশ কমিশনার পরেশ রায় বলেন,জোহর আলী মল্লিকের মতো শিল্পীদের জাতীয় স্তরের পুরস্কার পাওয়া উচিত। তাদের যথাযথ মূল্যায়নের জন্য তুলে ধরতে হবে। এজন্য পদ্ধতিগত দিক মেনে আবেদন করতে হবে। অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন বারাসাত পৌরসভার পৌর পারিষদ পান্নালাল বসু, বিশিষ্ট সমাজসেবী মাসুদ আলম বাবু, নীতা দাস, বারাসাত থানার আইসি শুভ্র সান্যাল, স্থানীয় পঞ্চায়েত প্রতিনিধি মোহাম্মদ আবু জার, মধ্যমগ্রাম ট্রাফিক পুলিশের কমিশনার সত্যজিৎ নস্কর, বারাসাত ট্রাফিক ওসিি নিশীথ বিশ্বাস প্রমুখ। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন শিক্ষক ও সাংবাদিক এনামুল হক।