আহমদ হাসান ইমরান: কে বেশি নৃশংস? ইসরাইলের নেতানিয়াহু, না মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জো বাইডেন? সত্যি কথা বলতে কি তা নিরূপন করা ক্রমশ কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। মনে হয়, ফিলিস্তিনবাসীদের ন্যায্য অধিকার দমন এবং তাদের উপর হত্যার হলোকাষ্ট চাপিয়ে দিতে এই দুই রাষ্ট্রনায়কের মধ্যে যেন প্রতিযোগিতা চলছে।
আমরা আগেই বলেছি, কীভাবে শত শত বছরের বাসিন্দা আরব মুসলিমদের ফিলিস্তিন থেকে উৎখাত করে খোলা আকাশের নিচে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। আর তারপরও এই উচ্ছেদকৃত ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইসরাইল একের পর এক বিশ্বাসঘাতকতা করে গেছে। সর্বশেষটি বোধহয় ছিল ওসলো চুক্তি যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন, ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী ইতজাক রবিন ও পিএলও প্রধান ইয়াসির আরাফাতের মধ্যে করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, এই চুক্তির বলে ফিলিস্তিন থেকে উচ্ছেদকৃত মুসলিমরা পশ্চিম তীর ও আরও কিছু অঞ্চল নিয়ে একটি আলাদা বাসভূমি পাবে। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইসরাইল শেষ পর্যন্ত নিজেরাই সেই চুক্তি বাস্তবায়িত করতে দেননি।
কেন, কোন অপরাধে লক্ষ লক্ষ ফিলিস্তিনিকে তাদের স্বদেশ থেকে হত্যা, ধ্বংস, পাশবিক শক্তি ব্যবহার করে উচ্ছেদ করা হল? তার জবাব আজও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের কাছে ফিলিস্তিনরা পায়নি। জায়নবাদী ইহুদি সন্ত্রাসবাদীদের কথা না হয় ছেড়েই দেওয়া গেল।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং তাঁর সহযোগী শাসকরা সমস্যাটিকে কীভাবে দেখছে তার দু-একটি উদাহরণ টানা যেতে পারে। যেমন মানবাধিকারের প্রবক্তা, গণতন্ত্রের ধ্বজাধারী জো বাইডেন গাজায় হামাস গ্রুপের সঙ্গে তাঁর পিয়ারা ইসরাইলের যুদ্ধের ব্যাপারে কিছু বাণী দিয়েছেন। রবিবার ওয়াশিংটনে মানবাধিকার প্রচার উপলক্ষে আয়োজিত এক আনন্দঘন ডিনারে জো বাইডেন বলেন, গাজায় যে ফিলিস্তিনি পরিবারগুলি রয়েছে, তাদের অধিকাংশের সঙ্গেই হামাসের কোনও সম্পর্ক নেই। আর ওই জনপদে যে মানবিক সংকট দেখা দিয়েছে, তার জন্য দায়ী হামাস।
যাতে ইসরাইলিরা অবাধে গাজায় আকাশ ও সমুদ্র পথে এবং স্থলসেনাদের দ্বারা ভয়ংকর হামলা চালাতে পারে, তার আয়োজন করতে তিনি বলেন, ‘আসলে হামাস গাজাবাসীকে মানব ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে যাতে ইসরাইল প্রতিশোধ নিতে সামরিক অভিযান চালাতে না পারে।’
প্রেসিডেন্টের বক্তব্য সমর্থন করে ব্লিংকেন বলেছেন, হামাস গাজার বেসামরিক ব্যক্তিদের ‘মানব ঢাল’ হিসেবে ব্যবহার করছে যাতে ফিলিস্তিনিরা দক্ষিণ গাজায় সরে যেতে না পারে।
ভালো কথা! ইসরাইলের হুকুম অনুযায়ী বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য লক্ষ লক্ষ লোক গাজা থেকে দক্ষিণাঞ্চলে সরে যাবে। প্রশ্ন উঠেছে, এই যে ২৩ লক্ষ বনি আদম সেখানে রয়েছে, তারা কীভাবে দক্ষিণাঞ্চলে যাবে? কোথায় তাদের জন্য পরিবহন? তারা কোথায় গিয়ে থামবে? এই ২৩ লক্ষ লোক দক্ষিণে গিয়ে কোথায় থাকবে? মধ্যপ্রাচ্যের তীব্র গরমে খোলা আকাশের নিচে নারী, শিশু, বৃদ্ধ ও অসুস্থরা কোথায় থাকবে? তাদের প্রাণধারণের জন্য পানি ও খাবার কে সরবরাহ করবে? কে তাদের জখম ও অসুস্থদের জন্য চিকিৎসার ব্যবস্থা করবে?
এইসব প্রশ্নের কোনও জবাব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা ইসরাইলিদের কাছে নেই। নেই তাদের তল্পি-বাহক মিশর বা সংযুক্ত আরব আমীরাতের কাছেও। জো বাইডেন কি বলতে চান, হামাসের মুজাহিদরা কোনও ধরনের প্রতিরোধ না গড়ে গাজা থেকে উধাও হয়ে যাবে? ’৪৮ সাল নাগাদ কে ফিলিস্তিনিদের ঘরবাড়ি, সম্পত্তি থেকে উৎখাত করেছিল? আর কারা ইসলামের তৃতীয় পুণ্যস্থান মসজিদুল আক্সাকে বার বার অপমান করে যাচ্ছে? নামাযীদের বাধা দিচ্ছে? আর এখনও ফিলিস্তিনিদের ঘরবাড়ি, জমি থেকে উৎখাত করে ইহুদিদের এনে বসাচ্ছে ইসরাইল। প্রতিবাদ করলেই চলছে গুলি। প্রতি বছর প্রায় ৩০০ ফিলিস্তিনি ইসরাইলি গুলিতে নিহত হচ্ছে।
প্রশ্ন হল, ইসরাইলের প্রতি এত সহানুভূতিসম্পন্ন জো বাইডেন কি কখনও এর প্রতিবাদ করেছেন? ফিলিস্তিনিদের মানবিক ও নাগরিক অধিকার দেওয়ার চেষ্টা করেছেন? তাদের সমস্যার কোনও সমাধানের নতুন পরিকল্পনা করেছেন? জবাব হল, না।
যেমন মার্কিন শাসক দল তেমনি বিরোধী রিপাবলিকান দলও কম যায় না। রিপাবলিকান দল থেকে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী নিকি হ্যালে আরব দেশগুলিকে একহাত নিয়েছেন। তাঁর বক্তব্য হল, এই যে ইসরাইল নির্দেশ দিয়েছে, সমস্ত ফিলিস্তিনিকে গাজা থেকে চলে যেতে হবে, যাতে ইসরাইল সেখানে নির্বিঘ্নে স্থল-অভিযান চালাতে পারে। তা সফল ও বাস্তবায়ন করার দায়িত্ব তো আরব ও মুসলিম দেশগুলির! তারা কেন গাজার ২৩ লক্ষ অধিবাসীকে নিজেদের দেশে ডেকে নিচ্ছে না? কেন মিশর সীমান্ত খুলে দিয়ে গাজার অধিবাসীদের সেখানে যেতে দিচ্ছে না? তিনি কয়েকটি দেশের নাম করে বলেন, কাতার কোথায়? কোথায় লেবানন, জর্ডন? কোথায় গেল মিশর? আপনারা তো জানেন, আমরা মিশরকে বছরে ১ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি সাহায্য করি। তারা কেন গাজার ফিলিস্তিনিদের জন্য তাদের সীমান্ত খুলে দিচ্ছে না? নিকি হ্যালে ইরানী পরমাণু চুক্তির জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করেন এবং বলেন, এই ইরানী তো হামাস ও হেজবুল্লাহকে শক্তিশালী করছে।
আর একজন ইসরাইলি রাজনীতিবিদ বলেছেন, ‘কেন বাবা! ফিলিস্তিনিদের তো মিশর নিয়ে তাদের সিনাই উপত্যকার মরুভূমিতে বসিয়ে দিতে পারে। কত ভালো হয়, যদি তারা তাঁবু শহরে ফিরে যায়।’
কিন্তু কেন ফিলিস্তিনিরা নিজেদের উর্বর ও বর্ধিষ্ণু ফিলিস্তিন ছেড়ে, মসজিদুল আকসাকে পরিত্যাগ করে অন্য কোথাও যাবে। তার কোনও উত্তর নেই। শুধু কথা হচ্ছে, তোমাদের যেতে হবে। ইসরাইলিদের তো বলা যায়, তোমরা জবরদখল করা ফিলিস্তিন ছেড়ে আফ্রিকা বা দক্ষিণ আমেরিকায় চলে যাও। সেখানে বিস্তর ভূমি পড়ে রয়েছে। আমেরিকা ও পশ্চিমা দেশগুলি তোমাদের অঢেল সাহায্য দেবে। তোমাদের কোনও অসুবিধা হবে না। কিন্তু কথা হচ্ছে, জায়নবাদী ইহুদিরা কি তাতে রাজি হবে? তারা শুধু একবারের পর পরের বার ফিলিস্তিনিদেরই নিজেদের স্বভূমি থেকে উৎখাত করতে চায়।
নিকি হ্যালে ইরানের পরমাণু গবেষণা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। ইরান ভারতের মতোই শান্তিপূর্ণ উদ্দেশে পরমাণু শক্তি ব্যবহার করতে চায়। ইরান এখনও কোনও পরমাণু বোমা তৈরি করেনি। তারা পরমাণু শক্তি গবেষণায় এগিয়ে চলেছে। কিন্তু তাতেও ইসরাইল ও পশ্চিমাদের বড় রাগ, বড় ক্রোধ, বড় ক্ষোভ। অথচ সারা দুনিয়া জানে, পরমাণু বিশেষজ্ঞরাও জানেন, ইসরাইলের কাছে ১০০-র বেশি ধ্বংসাত্মক পরমাণু বোমা রয়েছে। এ বিষয়টি নিয়ে কিন্তু পশ্চিমারা কখনই মুখ খোলে না। অর্থাৎ ইসরাইলের সাত কেন, সাত লক্ষ খুনও মাফ (ইসরাইলিরা এর থেকে বেশি সংখ্যক নিরপরাধ মুসলিমকে ফিলিস্তিনি থেকে বিতাড়িত করেছিল)। আর আমাদের বাঙালিদের ভাষায় বলা যায়, যত দোষ, নন্দ ঘোষ। অর্থাৎ ইরান, হেজবুল্লাহ, হামাস- ই সব বিপর্যয়ের জন্য দায়ি। নইলে তো পৃথিবীটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য জান্নাহতে পরিণত হত! কিন্তু হামাসের মুজাহিদরা দেখিয়ে দিয়েছে, সবসময় মার্কিন চক্রান্তের নকশা বাস্তবায়িত হবে না। পৃথিবী হয়তো অন্য পথেও হাঁটতে পারে।