আহমদ হাসান ইমরান: হঠাৎ করে দেখা যাচ্ছে মুসলিম মেয়েরা কামাল করে দিচ্ছেন। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একের পর এক তাঁরা তুলে আনছেন মর্যাদাময় পদক। যে সে পদক নয়, একেবারে নোবেল বিজয়ের পদক। ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের নার্গেস মুহাম্মদি ২০২৩ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়ার পর অনেকেই এ বিষয়টি নিয়ে ভাবতে শুরু করেছেন। নারী, জীবন এবং স্বাধীনতা সপক্ষে কাজ করার জন্য জেলবন্দি নার্গেস মুহাম্মদিকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। তিনি মানবাধিকারের পক্ষেও সরব। ইরানের ইসলামি প্রজাতন্ত্রের কর্তৃপক্ষ এ পর্যন্ত তাঁকে ১৩ বার আটক করেছে। আর নার্গেস মুহাম্মদি ৫ বার দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন।
দেখা যাচ্ছে, ২০০৩ সালেও আর এক ইরানি মহিলা শিরিন এবাদিকে নোবেল পদক অর্পণ করা হয়। নোবেল পুরস্কার কমিটির মতে, মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের বিকাশে অবদান করার জন্য এই ইরানি মহিলা অ্যাক্টিভিস্ট শিরিন এবাদিকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার অর্পণ করা হয়।
সদ্য সদ্য পুরস্কারপ্রাপ্ত নার্গেস মুহাম্মদি জড়িত শিরিন এবাদির সংগঠনের সঙ্গে এবং তিনি ওই সংগঠনের ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে রয়েছেন।
আর একজন যে মুসলিম মহিলা নতুন শতাধীর ২৩ বছরের মধ্যে শান্তিতে নোবেল পদকে সম্মানিত হয়েছেন তিনি হলেন তাওয়াক্কল কারমান। তিনি অবশ্য ইরানী নন, বরং যুদ্ধবিধ্বস্ত ইয়েমেনের নাগরিক। শান্তি প্রক্রিয়া এবং গণতন্ত্রের পক্ষে সক্রিয় ভূমিকা পালন করার জন্য এই মুসলিম নারী নোবেল পদক লাভ করেন।
আরও রয়েছে। ভারতের প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তানের বাসিন্দা মালালা ইউসুফজাই নারীশিক্ষা এবং উগ্রপন্থীদের বিরুদ্ধে সাহসিকতা প্রদর্শনের জন্য পাশ্চাত্যের এই শান্তি পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। ধ্বংসাত্মক ডিনামাইটের আবিষ্কর্তার রেখে যাওয়া অর্থেই এই শান্তি পুরস্কার! তবে মালালার শান্তি পুরস্কার পাওয়া ছিল সময়ের অপেক্ষামাত্র। কারণ, কয়েক বছর ধরেই শান্তি পুরস্কার প্রদানের জন্য তাঁর নাম সামনে আসছিল।
একই ভৌগোলিক এলাকা থেকে মুসলিম মহিলাদের শান্তিতে নোবেল জয়ীর এই দীর্ঘ মিছিল অবশ্যই নজর কাড়ার মতো। রাশিয়া ও অন্য কিছু রাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছে, পশ্চিমারা তাঁদেরই নোবেলে শান্তি পুরস্কার প্রদান করে যারা পশ্চিমাদের মূল্যবোধ ও ভৌগোলিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক স্বার্থের পক্ষে সংগ্রাম করে।
নার্গেস মুহাম্মদি এক বিবৃতিতে নিউ ইয়র্কস টাইমস-কে বলেছেন, আমি বৈষম্য, অত্যাচার, লিঙ্গভিত্তিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে এবং দমনমূলক ধর্মীয় সরকারের বিরুদ্ধে আমার লড়াই অব্যাহত রাখব। আমি আশা করব, শীঘ্রই পরিবর্তন আসবে।
উল্লেখ্য, পশ্চিমা-বিশ্ব বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং জার্মানি প্রথম থেকে ইরানের ইসলামি প্রজাতন্ত্রের ঘোরতর বিরোধী। তাঁরা ছিলেন ইরানে রাজতন্ত্র সমর্থক এবং শাহ-শাসকদের হেফাজতকারী। পশ্চিমা সবসময়ই চায় তাদের মূল্যবোধ এবং সংস্কৃতি ও নারীদের সম্পর্কে তাদের চাপিয়ে দেওয়া ধারণা যেন অন্য দেশগুলিও মেনে নেয়।
এ ছাড়া বিভিন্ন রাষ্ট্রের তেল, খনি ও প্রাকৃতিক সম্পদ লুঠ করার লক্ষ্যে তারা সবসময় নতজানু সরকারের পক্ষপাতী। এর উলটো কিছু হলেই পশ্চিমা মিডিয়া এবং সরকারগুলি দুনিয়া জুড়ে এক বিরূপ ধারণা তৈরি করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
মাহাসা আমিনি নামে ইরানের এক তরুণীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে পশ্চিমা-বিশ্ব, মিডিয়া এবং বুদ্ধিজীবীরা এক বিরাট আন্দোলন গড়ে তোলে। তারা রিজিম চেঞ্জ বা সরকার পরিবর্তনেরও ডাক দেয়। কিন্তু ইরানের কর্তৃপক্ষ পশ্চিমাদের এই আক্রমণকে ব্যর্থ করে দেয়। তাদের বক্তব্য ছিল, মাহাসা আমিনির মারা যাওয়ার ঘটনাটি কোনও হত্যা নয়, বরং এর কারণ ছিল তাঁর অসুস্থতা এবং এক দুর্ভাগ্যজনক দুর্ঘটনা।
এই প্রশ্ন ওঠে, যখন কালো নারী-পুরুষদের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশ ধারাবাহিকভাবে অবাধে হত্যা করে তখন কেন মাহাসা আমিনির মতো আন্দোলন, প্রচারণা বা সরকার পরিবর্তনের ডাক শোনা যায় না?
দুদিন আগেও ইরানে নারী সম্পর্কে অ্যাসোসিয়েট প্রেস এবং পিটিআই খবর প্রকাশ করেছে। এর শিরোনাম হচ্ছে, ইরানি কিশোরীর জখম ক্রোধে নতুন করে ঘৃতাহুতি দিয়েছে’। অর্থাৎ মাহাসা আমিনিকে নিয়ে ক্রোধ। আরমিতা জেরাভান নামে এক ইরানি কিশোরী ট্রেনে ওঠার পর হঠাৎই আহত হয়। তাঁর মা ও বাবা মিডিয়ার সামনে বলছেন, তাদের মেয়ের উচ্চরক্তচাপ রয়েছে। মাঝেমধ্যেই তার মাথা ঘোরে। কিন্তু হলে কী হবে! মেয়েটির মাথায় হিজাব ছিল না, কিংবা পড়ে গিয়েছিল। আর তাকে কেন্দ্র করে পশ্চিমা মিডিয়া প্রচার শুরু করেছে, এই তো আর এক মাহাসা আমিনিকে পাওয়া গেল! আবার ইরানে শুরু হবে জোরদার আন্দোলন। মেয়েটি কিন্তু এখন সুস্থই রয়েছে।