দেবশ্রী মজুমদার, নলহাটি: পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের মধ্যে এক সময় কোনও কাঁটাতারের বেড়া ছিল না। দুই বাংলা এক থাকায় হিন্দু-মুসলিমরা যৌথভাবে সমাজ, অর্থনীতি, সাহিত্য, সংস্কৃতি বিকাশে সহায়তা করত।
কিন্তু দেশভাগ সেই সুযোগ নষ্ট করেছে। তৈরি হয়েছে ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের। ভারতীয় উপমহাদেশ যেখানে সবাইকে ছাড়িয়ে যেতে পারত উন্নতিতে, সে-ই পিছিয়ে পড়েছে।
এই সমস্যা নিয়ে আলোচনা ও তার সমাধান খুঁজতে হীরালাল ভকত মহাবিদ্যালয়ে বুধবার এক আলোচনা চক্রের আয়োজন করা হয়েছিল। ‘ভারত উপমহাদেশের রাজনীতিতে বাঙালি জাতির অবদান: অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক এই সেমিনারে বিভিন্ন ক্ষেত্রের প্রথিতযশা মানুষ ও ছাত্রছাত্রীদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। স্বাগত ভাষণ দেন হীরালাল ভকত মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ ড. নুরুল ইসলাম। বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন প্রাক্তন সাংসদ ও দৈনিক পুবের কলম-এর সম্পাদক আহমদ হাসান ইমরান, তথ্যচিত্র নির্মাতা সৌমিত্র ঘোষ দস্তিদার, অধ্যাপক সৈয়দ এম জামান, শিক্ষক মামুন হাসান প্রমুখ।
বক্তব্য দিতে গিয়ে আহমদ হাসান ইমরান নীরদ চন্দ্র চৌধুরীর কথা উল্লেখ করে বলেন, আমাদেরকে ‘আত্মঘাতী বাঙালি’ হলে চলবে না। আজ বাংলাদেশ বিশ্বমঞ্চে প্রতিনিধিত্ব করছে। কুদরতে খুদার মতো বিজ্ঞানীকে ভূখণ্ডের বেড়াজালে ওপারে চলে যেতে হয়েছে। এভাবে বাঙালি খণ্ডিত হয়নি।
বাংলা ভাগ এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষতি করেছে। এ প্রসঙ্গে ইমরানের বক্তব্য, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে যদি আমরা ইইউ (ইউরোপীয় ইউনিয়ন) মডেল অনুযায়ী সহজ ভিসা, বাণিজ্যে পারস্পরিক সুবিধা এবং সাহিত্য-সংস্কৃত বিনিময়ের জন্য দরজা খুলে দিই, তাহলে উভয় বাংলাই লাভবান হবে। লাভবান হবে অসম-ত্রিপুরাও’।
ইমরান আরও বলেন, সীমান্ত হাটকে আরও বাড়াতে হবে। মুর্শিদাবাদে কি বর্ডার হাট হতে পারে না? তিনি যোগ করেন, প্রবীণ ব্যক্তিরা জানেন, আমাদের পূর্বপুরুষরা পাকিস্তান যেতেন ভিসা ছাড়াই। এখন ডাকের খরচ এত বেড়েছে যে পুবের কলম পত্রিকা বাংলাদেশে পাঠাতে অসুবিধা হচ্ছে। কেন এভাবে যোগাযোগ, মনের চলাচলকে আতান্তরে ফেলা হচ্ছে?
ভাষা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বাংলাভাষা আরবি, ফারসি-সহ বিভিন্ন ভাষার শধভাণ্ডারে নদীমাতৃক দেশের মতো পুষ্ট। কিন্তু এর সংস্কৃতির উপর আগ্রাসন চলছে। ফ্লাইটে বাংলাদেশ যাওয়ার সময় সেই দেশের এক ছোট বাচ্চার মুখে চোস্ত হিন্দি শুনে চমকে গিয়েছিলাম’।
ধর্ম প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ধর্ম কখনও মানুষকে ভাগ করেনি। ভাগ করেছে বর্ণবাদ। প্রণবদা অর্থাৎ আমাদের শ্রদ্ধেয় প্রয়াত রাষ্ট্রপতি একবার আমাকে বলেছিলেন, আমরা কর্নাটকের। লক্ষণ সেন, বল্লাল সেনরাও কর্নাটক থেকে আগত। তাতে অসুবিধা নেই। কিন্তু বর্ণবাদ এনেছিল বিভেদ।
ইসলাম তরবারির মাধ্যমে কায়েম হয়নি। নিম্নবর্ণ হিন্দু-দলিত, বৌদ্ধরা তাদের প্রতি অন্যায় অবিচারের কারণে ইসলাম গ্রহণ করেছিল। ভাবতে পারেন, নিম্নবর্ণের হিন্দু বেদ পাঠ করলেই তার কানে গরম সিসা ঢেলে দেওয়া হত! দেশপ্রাণ বীরেন্দ্রনাথ শাসমল গুরুত্ব পাননি। কারণ তিনি নিম্নবর্ণের ছিলেন। বঙ্গভঙ্গের আগেই বাঙালিকে খণ্ড করে সংখ্যালঘু করার চেষ্টা হয়েছে। না-হলে কলকাতা যা সারা দেশের রাজধানী ছিল, তা পাল্টে দিল্লি হয়? এখন উত্তরবঙ্গ ভাগের চক্রান্ত চলছে। এই অপচেষ্টা রুখে দিতে হবে।’
সৌমিত্র ঘোষ দস্তিদার জোরালোভাবে বলেন, আজও বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচারের কথা বলা হয়, এটা সর্বৈব মিথ্যা। আমার শত্রু দিল্লির মস্তিষ্ক। আজ কাঁটাতারের জন্য বাঙালি খুন হয় মুর্শিদাবাদ ও মালদহে। বাঙালিকে ‘বাংলাদেশি’ বলে দেগে দেওয়া হচ্ছে। এই চক্রান্ত আগেও হয়েছে। বিধান রায়ের আমলেও হয়েছে। তখন অন্নদাশঙ্কর রায় মুর্শিদাবাদের ডিএম। তাঁকে সরকারি ভাবে চিঠি দিলেও তিনি মেনে নিতে পারেননি যে সীমান্ত এলাকায় মুসলিম থাকবে না। আজও কিন্তু কেন্দ্র সেটাই করতে চাইছে। সবাইকে ‘বাংলাদেশি’ বলছে। সৈয়দ এম জামান বলেন, বাঙালি যেন সংখ্যালঘু না হয়। সবার মত প্রকাশের অধিকার থাকুক।