অর্পিতা লাহিড়ী: মেডিক্যাল কলেজ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, প্রেসিডেন্সি কলেজ ধরে সোজা রাস্তা হাঁটলেই অতীতের গন্ধমাখা একরাশ পুরনো বই। উবু হয়ে ফুটপাতেই বসে একমনে বই ঘেঁটে চলেছে কোন তরুণ পড়ুয়া বা সাদা- কালো চুলের মধ্য পঞ্চাশের কোন প্রৌঢ়। কলেজস্ট্রীট বইপাড়ায় গেলেই এটা অত্যন্ত পরিচিত এক ছবি।
কিন্তু করোনা অতিমারি, তারসঙ্গে ডিজিটাল আর সোশ্যাল মিডিয়ার বাড়বাড়ন্তে কেমন চলছে পুরনো বই বিক্রেতাদের কেনাবেচা। এইখবর নিতেই বেরিয়ে পড়া গেল।
প্রেসিডেন্সি কলেজের গেটের উল্টোদিকে এক পুরনো বই বিক্রেতা জানালেন “ দিদিমণি এখন সবাই মোবাইলে বই পড়েগো। নতুন বই কেনার লোকই নেই সেখানে আর কে ধুলো ঘেঁটে সখ করে পুরনো বই কিনতে আসবে বলো। ঘোলাটে চোখ আর আর একরাশ আক্ষেপ ঝরে পড়ে গলায়।
পথচলতি এক ব্যক্তি জানালেন পুরনো বই মানে কি শুধুই পুরনো বই। সেটা যে গুপ্তধনের আখর। বইয়ের ভিতর আবিষ্কার করা নামী-অনামী সই, ষ্ট্যাম্প সহ চিঠি, আরও কত কি যে মিলতো।
আসলে ৭০ বা ৮০ এর দশকে নববিবাহিত দম্পতি কে গল্পের বই উপহার দেওয়া ছিল রীতি। সেরকম মনোযোগী পাঠক না হলে সেই বই খবরের কাগজওয়ালার কাছে বিক্রি হয়ে যেত, তারপর তা হাতঘুরে চলে আসত কলেজস্ট্রীটের বইপাড়ায়।
শুধুই কি কলেজস্ট্রীট, নিউমার্কেট লাগোয়া ফ্রি স্কুল বা এখন যা মির্জা গালিব স্ট্রীটে মিলত ইংরেজি সাহিত্যের সম্ভার। খালিল জিব্রান থেকে মিলান কুন্দেরা, টমাস হার্ডি থেকে জেমস জয়েস, জয় অ্যাডামসনের বর্ণ ফ্রি , লিভিং ফ্রি বা জুলেভার্নের সাহিত্যসম্ভারের সঙ্গে পরিচিত হওয়া শুরু এই অঞ্চল থেকেই।
সুনীল, শক্তি , সমরেশের লেখার সঙ্গে আত্মিক যোগসূত্র গড়ে দিয়েছিল কলেজস্ট্রীটের পুরনো বইয়ের দোকান। ছাত্র পড়িয়ে যা বেতন মিলতো তার থেকেই পুরনো বইয়ের দোকানে দরদাম করে বাংলা সাহিত্যের স্বাদ নেওয়ার পালা চলত। এখন নিজের ১৮ বছরের কিশোর ছেলে কানে হেডফোন দিয়ে পছন্দের বইয়ের পডকাস্ট শোনে। এমনটাই জানালেন এক অভিভাবক।
করোনা অতিমারি পুরনো বইয়ের ব্যবসাকে আরও অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছে। বিগত দুবছরে অনেকটাই নষ্ট হয়ে গিয়েছে বইয়ের পাতায় চোখ রাখার অভ্যাস। এখন মোবাইলে পিডিএফে চোখ রাখলেই পড়ে নেওয়া যায় সাহিত্যের সেরা সম্ভারগুলি। বর্তমান “ টেকস্যাভি” প্রজন্মের কাছে তাই পুরনো কেন নতুন বই কিনে পড়াটাও এখন সময়ের অপচয়ের ছাড়া কিছুই নয়।
বই বিক্রেতারা বলছেন বিগত দুবছরে লকডাউনে অনলাইন বই ব্যবসা রমরম করে বেড়েছে। এখন পাঠকের ঘরে পৌঁছে যাচ্ছে বই। কলকাতার বইপাড়ার বইব্যবসার অশনিসঙ্কেতটা যেন বড়বেশি করে সামনে আসছে।