জিশান আলি মিঞা, বহরমপুর: ১৮ ডিসেম্বর ছিল বিশ্ব আরবি ভাষা দিবস। সারা বিশ্ব জুড়ে রাষ্ট্রসংঘ এবং ইউনেস্কোর উদ্যোগে এই দিনটি পালিত হয়। সেই উপলক্ষে একাধিক কর্মসূচি হাতে নিয়েছে মুর্শিদাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগ। সোমবার বহরমপুরে অবস্থিত মুর্শিদাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের পিজি ক্যাম্পাসে অনুষ্ঠিত হয় বিশেষ সেমিনার। সেখানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মুর্শিদাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চান্সেলর মিতা ব্যানার্জি। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন রাজ্যসভার প্রাক্তন সাংসদ ও পুবের কলম পত্রিকার সম্পাদক আহমদ হাসান ইমরান।
এছাড়া উপস্থিত ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ড. মেহেদী হাসান, গৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ড. নাজমুল হক, আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের প্রফেসর সায়েদুর রহমান প্রমুখ।
ড. মেহেদী হাসান বলেন, ১৮ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক আরবি ভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে ইউনেস্কো। আরবি এখন রাষ্ট্রসংঘের স্বীকৃতিপ্রাপ্ত ষষ্ঠ ভাষা। দিনটিকে আমরা বিভিন্নভাবে পালন করছি। মুর্শিদাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৫ ডিসেম্বর আরবি ভাষা দিবস উপলক্ষে এখানকার আরবি বিভাগ এক রক্তদান ক্যাম্পের আয়োজন করে।
সোমবার আরবি বিভাগের প্রথম সেমিস্টারের ছাত্রছাত্রীদের তৃতীয় সেমিস্টারের ছাত্রছাত্রীরা আনুষ্ঠানিকভাবে বরণ করেন। এই ছাত্রছাত্রীরা গান, কবিতা, গজল, হামদ, নাত পরিবেশন করেন। একটি ক্যুইজ প্রতিযোগিতারও আয়োজন করা হয়।
এদিন আরবি বিভাগের ছাত্রছাত্রীদের উৎসাহ ছিল চোখে পড়ার মতো। ড. মেহেদী হাসান বলেন, এবার আন্তর্জাতিক আরবি ভাষা দিবসের থিম ছিল ‘বিশ্বের সংস্কৃতি ও সভ্যতায় আরবি ভাষার অবদান’। আমরা বিষয়টি তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।
মুর্শিদাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চান্সেলর এদিন তাঁর বক্তব্যে বলেন, আরবি ভাষা একটি প্রাচীন ও প্রচলিত ভাষা। রাষ্ট্রসংঘ আরবি ভাষাকে বিশেষ সম্মান ও মর্যাদা দিয়েছে। আমরাও মর্যাদার সঙ্গে দিনটিকে পালন করছি। তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে আরবি বিভাগকে সমৃদ্ধ করতে যা যা করণীয় তা করা হবে। মুর্শিদাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়ারা আরবি ভাষায় সারা ভারতের জন্য আরও গৌরব নিয়ে আসবে বলে আমি আশাকরি।
আন্তর্জাতিক আরবি ভাষা দিবসে মুর্শিদাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের আমন্ত্রণে প্রধান অতিথি ছিলেন জনাব আহমদ হাসান ইমরান। তিনি প্রথমে এই আন্তর্জাতিক আরবি ভাষা দিবস পালনের জন্য উপাচার্য মিতা ব্যানার্জি সহ মুর্শিদাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগকে মোবারকবাদ জানান। তিনি বলেন, সাধারণত আমরা দু’টি ভুল করি। এক আরবি হচ্ছে মুসলিম ও আরবদের ধর্মীয় ভাষা, দুই আরবি কেবল সীমাবদ্ধ আরব ও উপসাগরীয় দেশগুলিতে।
এই দুটি কথার একটিও ঠিক নয়। বরং এতে আরবি ভাষা ও এর দ্বারা প্রচলিত ঐতিহ্য সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। একথা খুবই সত্যি যে, আরবি ভাষাতেই পবিত্র কুরআন নাযিল হয়েছে। রয়েছে হাদিস এবং অন্যান্য সম্পদ। কিন্তু একটু গবেষণা করলেই বোঝা যায়, আরবি একইসঙ্গে সংযোগ (কমিউনিকেশন এবং জ্ঞানবিজ্ঞানের ভাষা। দ্বিতীয়ত, আরবি ভাষা মোটেই আরব উপত্যকার ও উপসাগরের কয়েকটি দেশে সীমাবদ্ধ নেই।
এই বৃত্তের বাইরেও উত্তর আফ্রিকার দেশগুলি যেমন আলজেরিয়া, মরক্কো, তিউনেশিয়া, সোমালিয়া, সুদান, চাদ, ইথিওয়াপিয়ার একাংশ হচ্ছে আরবি ভাষি। তারপর বোখারা, সামরখন্দ অর্থাৎ উজবেকিস্তান, কাজাকিস্তান মধ্য এশিয়ার প্রভৃতি দেশেও আরবির প্রভাব অনস্বীকার্য।
ইমরান বলেন, জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় আরবির এক ঐতিহাসিক ও অনবদ্য ভূমিকা রয়েছে। প্রফেট মুহাম্মদের শিক্ষায় অনুপ্রাণিত হয়ে আরবরা জ্ঞান-বিজ্ঞান নিয়ে ব্যাপক গবেষণায় লিপ্ত হন। তাঁদের অর্জন ছিল বিস্ময়কর। আরবরা বিজ্ঞান, দর্শন, স্থাপত্যবিদ্যা, জ্যোর্তিবিজ্ঞান, সমুদ্র বিজ্ঞান, চিকিৎসা, বীজগণিত বিশেষ করে অ্যালজেবরা প্রভৃতি ক্ষেত্রে গবেষণার দ্বারা অসামান্য অবদান রাখেন। বলতে গেলে, ইউরোপের জ্ঞানচর্চার উদ্যোগ ও রেনেসাঁর উন্মেষে আরবদের অবদান অতুলনীয়। আর এর জন্য আরবরা আরবি ভাষাকে অবলম্বন করেছেন।
জ্ঞান-বিজ্ঞান, প্রযুক্তির যে পরিভাষা তা নির্মাণেও আরবি ভাষা অনন্য। এছাড়া জ্ঞান হচ্ছে আমাদের হারনোর সম্পদ। তাকে যেখানে পাও আত্মস্থ কর, এই বাণীতে উদ্বুদ্ধ হয়ে আরবরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে জ্ঞান-বিজ্ঞান, দর্শনে অভূতপর্ব উন্নতি করেন। তাঁরা গ্রিক ও অন্যান্য দেশের জ্ঞানকে আত্মস্থ করে তাকে নবায়ণ করে সম্পূর্ণ এক নতুন অবয়ব দেন।
ইমরান বলেন, আরবি ভাষায় লেখা হাজার হাজার মূল্যবান পাণ্ডুলিপি ইংরেজি ও অন্য ভাষায় অনুবাদের অপেক্ষায় রয়েছে। আমাদের দেশ ভারতেও এশিয়াটিক সোসাইটি, হাজারদুয়ারির গ্রন্থাগার প্রভৃতি স্থানে আরবি ও ফারসি মূল্যবান পাণ্ডুলিপিগুলি অনুবাদ ও সংরক্ষণের অপেক্ষায় রয়েছে। এটা সম্পন্ন হলে বিশ্বের জ্ঞান-বিজ্ঞান আরও ঋদ্ধ হবে।
পুবের কলম পত্রিকার সম্পাদক আহমদ হাসান ইমরান আরও বলেন,পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষাতে আরবি ভাষার শব্দরাজি ও পরিভাষার ব্যাপক অবদান রয়েছে।
আমাদের বাংলা ভাষাতেও ৮ হাজারের বেশি আরবি ও ফারসি শব্দ অভিধানে সংকলন করা হয়েছে। আরবির প্রভাব এতই শক্তিশালী ছিল যে, তুর্কী ভাষা লেখা হত আরবি হরফে। কেমাল আতাতুর্ক আরবি হরফকে নিষিদ্ধ করে তা রোমান অক্ষরে পরিবর্তিত করেন।
তবে এখন আবারও আরবি হরফে তুর্কী ভাষা লেখা চালু হয়েছে। একইভাবে মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, উর্দু, সোমালি প্রভৃতি ভাষারও হরফগুলি রয়েছে। হরফ বা অক্ষরগুলি লেখা হয় আরবিতে। তিনি এই বলে শেষ করেন যে, ভারতীয় উপমহাদেশ এবং আমাদের অখণ্ড বাংলাতেও আরবি ভাষা চর্চার একটা সমৃদ্ধ ইতিহাস আমরা দেখতে পাই। আরবি ভাষা চর্চা মুর্শিদাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগ দেশের অন্যান্য শিক্ষ প্রতিষ্ঠানগুলিকেও অনুপ্রাণিত করবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।