পুবের কলম, বিশেষ প্রতিবেদক মুর্শিদাবাদের নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার পতনের মাধ্যমেই ভারতের স্বাধীনতার সূর্য অস্তগামী হয়েছিল। নবাবী শাসনামলে একসময় লন্ডনের সঙ্গেও তুলনা হত এই শহরের। ভৌগোলিক দিক দিয়েও এই জেলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দক্ষিণবঙ্গের সঙ্গে উত্তরবঙ্গের সংযোগস্থাপনকারী একমাত্র জেলা এটি। জনসম্পদের বিচারেও দুই পরগনার পরই এর স্থান। পশ্চিমবঙ্গে তৃতীয় হলেও মুর্শিদাবাদের জনসংখ্যা কিন্তু পৃথিবীর বহু রাষ্ট্রের থেকেও বেশি। রাজ্যের প্রায় দশ শতাংশ মানুষ বসবাস করেন এই জেলায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, স্বাধীনতার প্রায় সত্তর বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরও এই জেলার কপালে কোনও পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় জোটেনি। সাচার কমিটির রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পর আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল মুর্শিদাবাদের আহিরন অঞ্চলে। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের অবহেলার ফলে এর অগ্রগতি সম্ভব হয়নি। মাত্র ৩-৪টি বিষয়ে এখানে পড়ানো হয়। এই বিষয়গুলির জন্য উপযুক্ত আবাসিক কাঠামো এখনও গড়ে ওঠেনি। বিগত সব সরকারই বিমাতৃসুলভ আচরণ করেছে একদা বঙ্গের রাজধানী এই জেলার সঙ্গে।
অবশেষে রাজ্যের অবিসংবাদিত জননেত্রী, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত ধরে মুর্শিদাবাদ জেলায় একটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপনের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়। ২০১৮ সালে বিধানসভায় পেশ হয় ‘দ্য মুর্শিদাবাদ ইউনিভার্সিটি অ্যাক্ট ২০১৮’। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি কে. এন. কলেজের অধ্যক্ষা সুজাতা ব্যানার্জিকে মুর্শিদাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য মনোনীত করা হয়। নিযুক্ত হওয়ার পর উপাচার্য উচ্চশিক্ষা দফতরকে চিঠি
লিখে, মুর্শিদাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় ১৪টি বিষয়ে স্নাতকোত্তরে অ্যাকাডেমিক পঠন-পাঠন শুরু করার অনুমতি চান। সেই অনুমতি মেলে ১৪ জুলাই ২০২১ তারিখে। দেখা যায় উপাচার্যের পরামর্শ অনুসারে ১৪টি বিষয়ে স্নাতকোত্তর কোর্সে নিম্নলিখিত ভাবে আসন সংখ্যা বরাদ্দ করা হয়। বাংলা (৬০), রাষ্ট্রবিজ্ঞান (৬০), ইতিহাস (৬০), দর্শন (৬০), সংস্কৃত (৮০), শিক্ষা বিভাগে (৪০), ইংরেজি (৪০), আইন (৪০), গণিত (৪০), সাইকোলজি (২৫), সেরিকালচার (২৫), ফিজিক্স (২৫), বোটানি (২৫), ভূগোল (২৫)। দু’টি বিষয়ে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। একটি হল সংস্কৃতে এমএ পড়ার জন্য সব বিষয়ের থেকে বেশি ৮০টি আসন বরাদ্দ করা। আর মুর্শিদাবাদের ১৪টি কলেজে আরবি পড়ানো হলেও এবং মুর্শিদাবাদ জেলায় আরবি পঠন-পাঠনের এক গৌবরময় ঐতিহ্য থাকলেও মুর্শিদাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে আরবি ভাষায় স্নাতকোত্তর পড়ানোর জন্য কোনও বিভাগ খোলা হয়নি। আর বাংলা ও ইংরেজিতে বরাদ্দ করা হয়েছে যথাক্রমে ৬০ ও ৪০টি আসন।
বাংলার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃতের জনপ্রিয়তা ইংরেজি ও বাংলাভাষাকে ছাড়িয়ে গেছে, এটা বিশ্বাস করা একটু মুশকিল। কিন্তু মুর্শিদাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয়া উপাচার্য সুজাতা ব্যানার্জি যখন ভেবেছেন, মুর্শিদাবাদ জেলায় সংস্কৃতের উপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব আরোপ করলে জেলাবাসী ও পারিপার্শ্বিক এলাকা ব্যাপকভাবে এগিয়ে যাবে। তাহলে বুঝতে হবে নিশ্চয়ই মাননীয়া উপাচর্য হয়তো এ বিষয়ে গবেষণা উপলব্ধ তথ্য ও পরিসংখ্যানের অনুসারে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
অন্যদিকে, মুর্শিদাবাদ জেলার ১৪টি কলেজে আরবি থাকা সত্ত্বেও বিশ্ববিদ্যালয় আরবিকে বিষয় হিসেবে বাদ দেওয়ায় ব্যাপক ক্ষোভের সঞ্চার হয়। বহু সংগঠন উপাচার্য সুজাতা ব্যানার্জিকে আরবি চালু করার দাবিতে স্মারকলিপি প্রদান করে। উল্লেখ্য, কলেজ ছাড়াও জেলার অসংখ্য সরকারি স্কুল, মাদ্রাসা, সিনিয়র মাদ্রাসাতেও আরবি ভাষা ও সাহিত্য পড়ানো হয়। এসব বাস্তবতা জানা সত্ত্বেও কোন অজ্ঞাত কারণে আরবিকে বাদ দেওয়া হল, তা জানতে বিভিন্ন বিশিষ্ট ব্যক্তি ও সংগঠনের পক্ষ থেকে উচ্চ শিক্ষা দফতর ও উপাচার্য সুজাতা ব্যানার্জির সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। পত্রপত্রিকাতেও ব্যাপক সমালোচনা হয়। এ দিকে গত ১৬ জুলাই বিকাশ ভবনে উচ্চ শিক্ষামন্ত্রীর দফতরে আরবি চালুর লিখিত দাবি নিয়ে ডেপুটেশন দিতে যান কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান তথা রাষ্ট্রপতি পুরস্কারপ্রাপ্ত অধ্যাপক বদিউর রহমান, আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগীয় প্রধান ড. সাইদুর রহমান এবং গৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন প্রধান ড. মেহেদি হাসান। সূত্রের মতে, ঘটনা জেনে উচ্চ শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুও বিস্মিত হন এবং তাঁদেরকে জানানো হয় যে, মুর্শিদাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আরবি বিভাগ চেয়ে রিক্যুইজিশন পাঠালেই মন্ত্রক অবশ্যই অনুমোদন দিয়ে দিবে। এরপর মুর্শিদাবাদ জেলার বিভিন্ন কলেজের আরবির অধ্যাপকরা উপাচার্যের সঙ্গে দেখা করেন। এ ছাড়া এসআইও, মাদ্রাসা ফোরাম সহ বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের পক্ষ থেকেও প্রতিনিধিদল উপাচার্যের সঙ্গে দেখা করে আরবি চালুর দাবি জানায়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যারাবিক অ্যালুমনি অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকেও উপাচার্যের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ডেপুটিশন দেওয়া হয়।
এই পরিস্থিতিতে যে চাপ তৈরি হয় তার প্রেক্ষিতে মাননীয়া উপাচার্য সুজাতা ব্যানার্জি বিভিন্ন প্রতিনিধি দলকে বলেন, তিনি ২৭ জুলাই উচ্চশিক্ষা দফতরে আরবি বিভাগ চালু করার জন্য নাকি একটি ‘রিক্যুইজিশেন’ প্রেরণ করেছেন। (মেমো নং ৬ ()() ৯১/২০২১-২২)। কিন্তু উচ্চ শিক্ষা দফতর সূত্রে জানা যায় যে, আরবি চালু করা নিয়ে যে চিঠি উপাচার্য লিখেছেন সেটি কোন ‘রিক্যুইজিশন চিঠি’ নয়। বরং তাতে বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠনের পক্ষ থেকে আরবি বিভাগ চালু করার দাবি জানানো হয়েছে, সেগুলিকেই তিনি ফরোয়ার্ড করেছেন মাত্র। কোন বিভাগ চালু করতে হলে তার জন্য নির্দিষ্ট ফরম্যাটে রিক্যুইজিশন পাঠাতে হয়। সেটি কিন্তু উপাচার্য মহাশয়া করেননি। উপাচার্য মহাশয়া বিভিন্ন প্রতিনিধি দলকে বলেছেন, তিনি তো রিক্যুইজিশন লেটার পাঠিয়ে দিয়েছেন। যদিও উচ্চশিক্ষা দফতরের সূত্র ওই চিঠিকে ‘আরবির রিক্যুইজিশেন লেটার’ হিসেবে মান্যতা দিতে রাজি হননি।
তবে বিভিন্ন প্রতিনিধি দলের কাছে উপাচার্য সুজাতা ব্যানার্জি একটি আশ্চর্যজনক ও অদ্ভূত দাবি জানিয়েছেন। তিনি বিভিন্ন প্রতিনিধি দলগুলিকে বলেন, পশ্চিমবঙ্গে সংখ্যালঘুদের জন্য একটি সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয় রয়েছে। তারা যদি আরবি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ খোলার জন্য একটি বিল্ডিং নির্মাণ করে দেন তবেই তিনি মুর্শিদাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে আরবি বিভাগ খুলতে চেষ্টা করবেন!
মাননীয়া উপাচার্য আরও বলেছেন, মুর্শিদাবাদ একটি সংখ্যালঘু প্রধান জেলা। তাই সংখ্যালঘু দফতরের এই বিষয়ে নজর দেওয়া প্রয়োজন। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকাঠামোগত যা অবস্থা তাতে আরবি বিভাগ খোলা সম্ভব নয় বলে তিনি জানান। ‘পুবের কলম’-এর পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলেও তিনি স্পষ্টভাবে একই কথা বলেন। এতদ্ব্যতীত তিনি জানান, সংখ্যালঘু দফতর ছাড়াও কোন সাংসদ তাঁর ফান্ড থেকে কিংবা মুর্শিদাবাদের কোনও দানশীল ধনী সংখ্যালঘু ব্যক্তি বিল্ডিং তৈরি করে দিলে তিনি আরবি বিভাগ খুলতে অবশ্যই চেষ্টা করবেন। উপাচার্যের এহেন দাবিতে জেলার শিক্ষাপ্রেমীরা বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। কারণ, রাজ্যের কোনও বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজকে সংখ্যালঘু দফতর আজ অবধি কোনও বিল্ডিং তৈরি করে দেয়নি। তাহলে হঠাৎ কেন মুর্শিদাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য সংখ্যালঘু দফতর টাকা বরাদ্দ করবে? আরও প্রশ্ন উঠেছে, অন্যান্য বিভাগের জন্য এখন বা ভবিষ্যতে বিল্ডিং তৈরি করে দিতে হবে এমন কোনও দাবি তিনি তোলেননি। শুধু আরবির ক্ষেত্রে কেন এই ভিন্নতা? সংখ্যালঘু প্রধান জেলা বলে শুধু আরবির জন্য বিল্ডিং গড়ে দিতে হবে, এ দাবিরও ন্যায্যতা বোঝা সম্ভব নয়। আরবি একটি আন্তর্জাতিক ভাষা। পৃথিবীর বিভিন্ন অমুসলিম দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ও আরবি ভাষা ও সাহিত্যের জন্য বিভাগ রয়েছে। এই তথ্য পরিসংখ্যান পাওয়ার জন্য বেশি পরিশ্রম করতে হবে না। সামান্য গুগল করলেই সারাবিশ্বের দীর্ঘ তালিকাটি উপাচার্য মহাশয়ার সামনে ফুটে উঠবে। এছাড়া মাননীয়া উপাচার্য কেন ভাবছেন যে, মুর্শিদাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু সংখ্যালঘুরাই আরবি পড়বে। কোনও হিন্দু বা খ্রিস্টান ছাত্রছাত্রী আরবি
পড়তে পারবে না, তাও ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। কোনও ভাষার সাম্প্রদায়িকীকরণ পশ্চিমবঙ্গের মতো প্রগতিশীল ও সম্প্রীতির দীর্ঘ ঐতিহ্যবাহী রাজ্যে এই ধরনের প্রচেষ্টা অবশ্যই নিন্দনীয়।
সূত্রের খবর, বিষয়টি মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীরও গোচরে এসেছে। তিনি জঙ্গিপুরের সাংসদ খলিলুর রহমানকে এ নিয়ে উচ্চ শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুকে একটি চিঠি লিখতে বলেন। সেই মোতাবেক সাংসদের এক প্রতিনিধি গত ২১ জুলাই উচ্চ শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুর অফিসে সাংসদ খলিলুর রহমানের চিঠি পৌঁছে দেন। সাংসদ নিজেও উপাচার্যের সঙ্গে কথা বলেন।
সবকিছু জানা সত্ত্বেও মাননীয়া উপাচার্যের এহেন কথা ও আচরণের কোন ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। এ দিকে তিনি গত ৩ জুলাই বিষয়টি নিয়ে মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীকে একটি চিঠি লিখেছেন। চিঠিটি তিনি উচ্চশিক্ষা দফতর ও সংখ্যালঘু দফতরকে ফরোয়ার্ড করেছেন (মেমো নং ()) ১৯/২০২১-২২)। যদিও মুর্শিদাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সংখ্যালঘু দফতরের কোনও সম্পর্ক নেই। এই চিঠিটি ‘পুবের কলম’ পত্রিকার হাতেও রয়েছে। সেখানেও উপাচার্য তাঁর পুরনো কথার পুনরাবৃত্তি করে জানিয়েছেন যে, রাজ্য সরকার যদি পরিকাঠামোর (ভবন, পাঠাগার, শিক্ষক) জন্য অর্থ সাহায্য করে তাহলে তিনি আরবি, উর্দু বিভাগ খোলার যে দাবি, তা পূরণের চেষ্টা করতে পারেন।
কাজেই এত চিঠিপত্র ও কথা চালাচালি সত্ত্বেও মুর্শিদাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে আরবি ভাষা ও সাহিত্যের বিভাগ খোলার দাবি পূরণ নিয়ে ধোঁয়াশা মোটেই দূরীভূত হয়নি।