আহমদ হাসান ইমরান: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স প্রভৃতি দেশের মানবিকতার পরাকাষ্ঠা দেখলে চোখে পানি ধরে রাখা মুশকিল। তারা যেভাবে ইরানি তরুণী মাহশা আমিনীর মৃত্যুর পর প্রতিবাদ ও চুল কাটার ধুম, দেখলে মনে হবে, তারা সত্যি সত্যি নির্যাতিতা, নিপীড়িতা ইরানি তরুণীদের পক্ষে। কিন্তু তাদের নিজেদের কর্মকাণ্ড দেখলে মনে হবে, তারাও তো একই অপরাধে অপরাধী। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কি ভুলে যাচ্ছে হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে আণবিক বোমা ব্যবহার করে কত হাজার হাজার এশিয়দের (জাপান) তারা হত্যা করেছে। ফ্রান্স আলজেরিয়াতে যে গণহত্যা চালিয়েছিল, তার জন্য এখনও ক্ষমা চায়নি।
জার্মানি ইহুদিদের যেভাবে গ্যাস চেম্বারে নিকেশ করেছে, তা তো ফ্যাসিবাদীর কাছে মডেল হয়ে রয়েছে। ইসরাইল নিজেও ফিলিস্তিনিদের উপর সেই একই প্যাটার্নে গণহত্যা চালাচ্ছে। এছাড়া আমেরিকা যেভাবে কৃষ্ণাঙ্গ নারী-পুরুষদের লাগাতার হত্যা করে যাচ্ছে, তা এখন সুবিদিত।
এ জন্যই হয়তো বা ভারতীয় মুনি-ঋষিরা বলেছিলেন, ‘আপনি আচরি কর্ম, পরেরে শিখাও’। কিন্তু মুনি-ঋষিদের কথায় পশ্চিমারা কি কান দেবে! তাদের রয়েছে নানা স্বার্থ। কখনও তা রাজনৈতিক, কখনও তা অর্থনৈতিক, কখনও সাংস্কৃতিক আবার কখনও বা ভৌগোলিক বা সামরিক আধিপত্য।
তাই অনেকেরই ঘোরতর সন্দেহে সত্যি কি ইরানে কিছু পাশ্চাত্যমনা নারীর হিজাব ত্যাগ করার ইচ্ছাটাই হল আসল ইস্যু! না পাশ্চাত্যের কাছে ইরানের পদানত হতে না চাওয়া এবং তার তেল সম্পদ ও পরমাণু গবেষণার অগ্রগতিই হচ্ছে মূল বিষয়। তারা ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের মুসলিম শাসকদের উৎখাত করতে চায়।
আরও একটি প্রশ্ন, এতই যদি ইরানি জনগণের জন্য প্রেম, তাহলে লাগাতার অর্থনৈতিক অবরোধ দ্বারা কেন ইরানি জনগণকে বিপর্যস্ত করে চলেছে আমেরিকা ও ইউরোপ? কেন ওষুধের অভাবে শত শত ইরানের শিশু মারা যাচ্ছে? কিন্তু না, এখন আমেরিকার প্রয়োজন হিজাব। মাথা থেকে হিজাব খুলতে না পারলে আমেরিকার সম্মান ও মানবিকতা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
মাহশা আমিনীর পর পাশ্চাত্য আরও একটি ইরানি মহিলাকে হাতের কাছে পেয়েছে। তাঁর নাম এলনাজ রেকাবি। তিনি সিওলে ইরানের খেলোয়াড় দলের একজন হিসেবে এসেছিল ক্লাইম্বিং চ্যাম্পিয়ানশিপে অংশ নিতে।
আরোহণ করার সময় এলনাজ রেকাবি মাথায় যে হিজাব পরেছিল তা খুলে পড়ে। আর যায় কোথায়! পশ্চিমা মিডিয়া হইহই করে উঠল, এই তো আরও একজনকে পাওয়া গেল যে হিজাব পরিত্যাগ করেছে। পাশ্চাত্যের শুধু মিডিয়া নয়, সরকারগুলিও এলনাজকে হিরোইনের মর্যাদায় ভূষিত করল। আর ঘোষণাও দিল যে, তারা এলনাজ রেকাবির পাশেই রয়েছে।
কিন্তু শুধু মুখে বললে তো হবে না, পাশ্চাত্যের মিডিয়া এবং ক্রীড়া ফেডারেশনগুলির ধারণা হল, এলনাজ রেকাবি ইরানে ফিরে গেলে ‘মোল্লারা’ নিশ্চয়ই তার মুণ্ড খসিয়ে দেবে। আর তা না হলে তার ভাগ্যে রয়েছে যাবজ্জীবন কারাগার।
এরপর তাঁকে নিয়ে আর কোনও ঘটনা না হলেও রটনা চলতে থাকে সমানে। মাথার হিজাব খুলে পড়ার অপরাধে সিওলে ইরানি দূতাবাসের কর্মকর্তারা এলনাজ রেকাবির পাসপোর্ট এবং মোবাইল ফোন কেড়ে নিয়েছে। দুইদিন পর নাকি তেহরানের উদ্দেশে এলনাজের ফ্লাইট ধরার কথা ছিল! কিন্তু ইরানি কর্মকর্তারা খুব ভোরের একটি বিমানে করে তাকে ইরানে পাচার করে দিয়েছে।
আর ক্লাইম্বিং ফেডারেশন এবং মিডিয়া সমানে এলনাজ রেকাবির নিরাপত্তা নিয়ে ‘যা ইচ্ছা তাই’ লিখতে থাকে। এগুলি লেখার অধিকার তো পাশ্চাত্য মিডিয়ার রয়েছেই। ইরানের ‘মোল্লাতন্ত্র’ নিয়ে রয়টার্স, বিবিসি, এপি, ডয়চেভেলে লিখবে না তো কে লিখবে! তাদের উপরই তো মহান দায়িত্ব, ইরানি মেয়েদের প্রগতির দিকে নিয়ে আসার। হিজাব পরিত্যাগ করিয়ে ‘বোল্ড অ্যান্ড ব্রেভ’ বিকিনি পরিয়ে মহিলা প্রগতির শীর্ষে নিয়ে আসার।
কিন্তু হায়! সব কিছুতে ঠাণ্ডা পানি ঢেলে দিয়েছে এলনাজ রেকাবি নিজে। কিন্তু তার আগে জার্মান সংবাদসংস্থা ডয়চেভেলের একটি শিরোনামের দিকে নজর দিতে পারেনn ‘হিজাব যিনি আরোহণ করেছিলেন সেই ইরানি মহিলা অ্যাথলেটের জন্য বিষম দুঃশ্চিন্তা’। একই ধরনের চিন্তা কিংবা দুঃশ্চিন্তা ব্যক্ত করে অন্যান্য পাশ্চাত্য সংবাদমাধ্যমও। কিন্তু আসলে তো দেখতে হবে এলনাজ রেকাবি নিজে সংবাদমাধ্যমকে কি বলেছেন।
এলনাজ রেকাবি বলেন, আরোহণ করার সময় ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও তার মস্তকাবরণ মাথা থেকে খুলে পড়ে যায়। ইনস্টাগ্রামে স্বয়ং একটি পোস্ট লিখে এলনাজ একথা সারা বিশ্বকে জানিয়েছেন। বিবিসি এও প্রচার করে এলনাজ রেকাবি নিখোঁজ। তাঁর আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুরা তার সঙ্গে যোগাযোগ করতেই পারছে না। ইনস্টাগ্রাম পোস্টে এলনাজ এই বলে ক্ষমা চায় যে, তার জন্য অনেকেই দুঃশ্চিন্তায় পড়েছেন। এছাড়া এলনাজ তেহরানে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে বলেন, তাঁকে আগেই ইরানে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে, এটা ভুল। তিনি নির্ধারিত সূচি অনুযায়ী তাঁর দলের সঙ্গে তেহরানে ফিরে এসেছেন।
ইরানের ন্যাশনাল অলিম্পিক কমিটির প্রেসিডেন্ট খোশরাবি ভাপা বলেছেন, হিজাব পড়ে যাওয়ায় এলনাজ রেকাবির বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা গ্রহণের প্রশ্নই ওঠে না। কারণ, এলনাজ আমাদের বলেছেন, তাঁর হিজাব খুলে যাওয়া ছিল অনিচ্ছাকৃত। তিনি আরও বলেন, এটা খুবই তুচ্ছ বিষয়। কিন্তু ‘প্রথাগতভাবে’ এটা নিয়ে বাড়াবাড়ি করা হচ্ছে। আমি এলনাজের সঙ্গে কথা বলেছি। তাঁকে বলেছি, সে প্যারিস অলিম্পিকে কোয়ালিফাই হওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিক।
বিমানবন্দরে এলনাজকে তাঁর আত্মীয়স্বজনরা বিপুলভাবে স্বাগত জানায়। তাঁর হাতে বেশকিছু ফুলের তোড়া দেওয়া হয়। এলনাজকে যে গোপনে তেহরানে নিয়ে আসা হয়নি, তা এ থেকেও বোঝা যায় যে, তাঁর আত্মীয়স্বজন ও পরিচিতরা এলনাজ কোন সময় ফিরে আসছে তা জানত।
কিন্তু সব থেকে দুঃখের বিষয় হচ্ছে, পাশ্চাত্য মিডিয়া এলনাজের জন্য যে ছক সাজিয়ে ছিল, তা কিন্তু কামিয়াব হতে পারল না। এত চেষ্টা, এত কষ্ট, এত পয়সা সবই কিন্তু নষ্ট হয়ে গেল!