আহমদ হাসান ইমরান: পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতার মোমিনপুরে একটি অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটেছে। সেদিন ছিল লক্ষ্মীপুজো, নবী দিবস এবং বৌদ্ধদেরও একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান। আর এসব ক্ষেত্রে যা হয়, একটি সামান্য বিষয়কে নিয়ে রেষারেষির ঘটনায় একটি ছোট এলাকা ঘিরে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, পতাকা নামিয়ে দেওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে উত্তেজনার সৃষ্টি হয় এবং পরবর্তীতে মহল্লার মুরব্বি বা বয়স্কদের হস্তক্ষেপে তা প্রশমিত হয়ে পড়ে। কিন্তু তার আগে দু’পক্ষের মাথা গরম যুবকরা কয়েকটি বাড়ি ও দোকানে ভাঙচুর করে। কিন্তু পুলিশ প্রশাসন ও শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষদের চেষ্টায় তা ছিল সীমিত। আর যে সামান্য ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, প্রশাসন দ্রুত তার মেরামত এবং ক্ষতিপূরণেরও ব্যবস্থা করেছে।
তবুও পশ্চিমবঙ্গে এই ধরনের ঘটনাকে একমাত্র সাম্প্রদায়িক একটি গোষ্ঠী ছাড়া সকলেই নিন্দা করেছেন। আর সকলেই সচেষ্ট রয়েছেন, যাতে এমন অবস্থার পুনরাবৃত্তি না ঘটে।
কিন্তু স্বীকার করতেই হবে, এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে কয়েকটি সর্বভারতীয় টিভি চ্যানেল, নিউজ পোর্টাল ও সংবাদপত্র যে ধরনের মিথ্যা, ভুয়ো ও উত্তেজনা সৃষ্টিকারী খবর প্রচার করেছে তা এক ভিন্ন বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করেছে।
অবশ্য ভারতে বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ-সহ গুটিকয়েক রাজ্য ব্যতীত যে ঘৃণা-বিদ্বেষ এবং জিঘাংসার পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে তার পিছনে রয়েছে, তাতে গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ায় লাগাতার হেট ক্যাম্পেন। অবশ্য এ ছাড়াও রয়েছে পুলিশ প্রশাসনের একপেশে মনোভাব এবং আক্রান্তকেই দোষী সাবস্তের চেষ্টা। যেকোনও ঘটনাকে এমন রং দেওয়া হচ্ছে, যেমন মনে হবে একটি সম্প্রদায়ের মানুষ হচ্ছে দানব।
আর তাদের বধ করা পবিত্র কর্তব্য। যারা নিরীহ মানুষ লিঞ্চিং করে মারছে, যারা বিলকিস বানুর মতো অসহায় এক নারীর আত্মীয় পরিজন-সহ ১৮ জনকে খুন ও ধর্ষণ করেছে, তার ছোট শিশুকে তার সামনেই আছাড় মেরে হত্যা করেছে, সেই অপরাধীদের অবাধে জামিন কিংবা মুক্তি দেওয়া হচ্ছে। আর ফুলমালা পরিয়ে, মিষ্টি খাইয়ে সমাজে স্বাগত জানানো হচ্ছে। তাদের কাছ থেকে আর কি ধরনের আচরণ আশা করা যায়!
মোমিনপুরের ঘটনাতেও ফেক তথ্য, ফেক ভিডিয়ো বা অন্য দেশের ভিডিয়ো ক্লিপ প্রচার করে বলা হচ্ছে, এই দেখুন, কী হচ্ছে। পুলিশ ইতিমধ্যেই এই ধরনের প্রচারকারীদের কয়েকজনের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করেছে।
বিজেপির একজন তাবড় নেতা টিভিতে বললেন, এই মোমিনপুর আগে ছিল হিন্দু অধ্যুষিত। ‘ওদের অত্যাচারে অনেক হিন্দু এলাকা ছেড়ে চলে গেছে। মোমিনপুর নাম শুনেই আপনাদের বোঝা উচিত, এটা ছিল হিন্দু প্রধান এলাকা।’
সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারিত আরও বক্তব্য হচ্ছে, পুলিশ কোনও ব্যবস্থাই নিচ্ছে না ইত্যাদি আরও কুৎসিত এবং প্ররোচক তথ্য, বক্তব্য ভিডিয়ো। খুব কম লোকই জানেন ভিডিয়োকে সফটওয়ারের সাহায্যে নানাভাবে এডিট করা যায়। নিট রেজাল্ট হচ্ছে, ভাই ভাই বা প্রতিবেশীদের মধ্যে সৃষ্টি হচ্ছে পারস্পরিক অবিশ্বাস, আতঙ্ক। পরিচিতের মুখ ঢেকে যাচ্ছে অপরিচিতির অন্ধকারে। গুজব ছড়াচ্ছে ইন্টারনেটের গতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে।
অথচ ওই এলাকার হিন্দু ও মুসলিম বাসিন্দারা বলছেন, আমরা পরস্পর মিলেমিশে বাস করি। পুজো কমিটির প্রেসিডেন্ট জয়ন্ত রায়ের বক্তব্য, আমাদের মধ্যে পারস্পরিক হিংসা কিংবা সহিংসতা কোনওদিনই ছিল না। আমরা একসঙ্গেই পুজো এবং ঈদ ও নবী দিবস পালন করি। যারা এই ছোট ঘটনাকে কেন্দ্র করে উত্তেজনা ছড়াবার চেষ্টা করছে, তারা কোনও সম্প্রদায়েরই ভালো চায় না। একই কথা ওই এলাকার মুসলিম বুর্জগদেরও।
বাংলায় হিন্দু- মুসলিম- বৌদ্ধরা প্রায় হাজার বছর ধরে পাশাপাশি পরস্পরের হাত ধরে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বাস করছে। এর মধ্যে বৌদ্ধরা অনেকে ধর্ম পরিবর্তন করে মুসলিম হয়েছে। ফলে বাংলায় বৌদ্ধদের সংখ্যা কমেছে। কিন্তু তা সার্বিক বাঙালির একসঙ্গে পথ চলায় বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। কিন্তু আজ তাতে ঘুণ ধরানোর চেষ্টা হচ্ছে। শুধু ঘুণ নয়, চেষ্টা হচ্ছে সম্প্রীতি, সৌহার্দ্য, ভ্রাতৃত্ববোধকে পুরোপুরি বিনাশ করার।
কিন্তু বাংলার মানুষ জানে, আমরা হাজার বছর ধরে একসঙ্গে পথ হেঁটেছি। আমাদের ভাষা এক, খাদ্যাভাসও প্রায় এক। রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের শিক্ষাও এক। যাইহোক না কেন আমাদের চলতে হবে একসঙ্গে, থাকতে হবে একসঙ্গে।