আবদুল খালেক অসমের বরপেটার কংগ্রেস সাংসদ। ইন্ডিয়া টু’ডের কনক্লেভে যোগ দিতে কলকাতায় এসেছিলেন। সম্পাদক আহমেদ হাসান ইমরান পুবের কলম দফতরে তাঁকে আমন্ত্রণ জানান। অসমের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে তাঁর মতামত শুনলেন প্রদীপ মজুমদার
প্রশ্নঃ ভয়াবহ বন্যা চলছে অসমে। এর কারণ কি?
উত্তরঃ অসমের মানুষ বন্যা মোকাবিলায় অভ্যস্ত। এটা একটা লাইফটাইম সমস্যা। আমার লোকসভা বরপেটার বিস্তীর্ণ এলাকা এখনও জলের তলায়। এই ভয়াবহ বন্যার দু’টি কারণ, প্রথমতঃ প্রচুর বৃষ্টিপাত। দ্বিতীয় কারণ হল ভুটানে একাধিক বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী বাঁধের কারণে নিম্ন অসমে প্লাবন দেখা দিচ্ছে। বিশেষ করে ভুটানের জাইকা বাঁধের থেকে ছাড়া জল ভাসিয়ে দিচ্ছে লোয়ার অসম।
প্রশ্নঃ তাহলে কি বাঁধগুলি দেওয়া ঠিক হয়নি বলে মনে করেন? বাঁধগুলি তো ভারত সরকারই ভুটানকে তৈরি করে দিচ্ছে।
উত্তরঃ বাঁধের বিরুদ্ধে আমি নই। জলবিদ্যুৎ উৎপাদনে বাঁধগুলি জরুরি। তবে আমার মনে হয়, নদী বাঁধগুলি বহুমুখী প্রয়োজনের দিকে নজর রেখে নির্মাণ করা দরকার। বিদ্যুৎ নির্মাণের পাশাপাশি কৃষিতে সেচের কাজেও ওই জল ব্যবহার হতে পারে। যাতে নিচু এলাকা প্লাবিত না হয় সেদিকেও বিশেষ নজর থাকা দরকার।
প্রশ্নঃ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ মানুষদের মধ্যে ত্রাণ নিয়ে অভিযোগ উঠেছে
উত্তরঃ সরকারি সাহায্য পর্যাপ্ত নয়। যখন বন্যা শুরু, মানুষ চরম দুর্দশায় তখন মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা সেদিকে নজর দিতে পারেননি। তখন তিনি ব্যস্ত ছিলেন গুয়াহাটির বিলাসবহুল হোটেলে আশ্রয় নেওয়া মহারাষ্ট্রের বিক্ষুব্ধ বিধায়কদের আতিথেয়তা করতে। তাঁরা মহারাষ্ট্রে ফিরে যাওয়ার পর মুখ্যমন্ত্রী জলে নামলেন। ততদিনে মানুষের দুর্দশা চরমে পৌঁছে যায়। ত্রাণ নিয়ে মানুষের ক্ষোভের শেষ নেই। সব জায়গায় ঠিকমতো ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছাচ্ছে না। তাছাড়া ১টি পরিবার ১ কোজি চাল পেলে ক’দিন চালাবে? বিশেষ করে নদী ভাঙণে আক্রান্তদের নিয়ে সরকারের কোনও উদ্যোগ নেই। মানুষগুলো কোথায় থাকবে, কি খাবে-সে সব নিয়ে সরকার কিছু ভাবছে না। এক্ষেত্রেও সরকার বাঙালি-অসমিয়া, হিন্দু-মুসলিম সমীকরণের খোঁজ চালাচ্ছে ।
প্রশ্নঃ এনকাউন্টারের নামে অসম পুলিশ বিনা বিচারে একের পর এক মানুষকে মেরে ফেলছে। এ বিষয়ে কি বলবেন?
উত্তরঃ আমরা এই ধরনের কথিত এনকাউন্টারের বিরোধী। কেউ অপরাধ করলে তাকে বিচারের কাঠগড়ায় তোলাই সাংবিধানিক রীতি। কিন্তু অসম পুলিশ কাউকে নির্দোষ প্রমাণের সুযোগ না দিয়ে যেভাবে গুলি করে, গাড়ি চাপা দিয়ে মেরে ফেলছে তা শুধু সংবিধান বিরোধী নয়, মানবাধিকার বিরোধীও। লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, এনকাউন্টারের নামে হিমন্ত বিশ্ব শর্মার পুলিশ যাদের মেরে ফেলছে, তারা হয় মুসলমান নয়তো সিডিউলকাস্ট। এ সব দেখে মনে হয়, আগামী দিনে যারা সরকারের কাজের বা নীতির বিরোধিতা করবে তাদেরও কথিত এনকাউন্টারের নামে মেরে ফেলা হতে পারে। আমি নিজেও সকলকে বলি, সরকারের নীতির বিরোধিতা করার জন্য যদি আমাকে মিথ্যা মামলায় আটক করা হয়,তখন যেন হাতকড়া পরিয়েই নিয়ে যাওয়া হয়। যাতে পুলিশকে আক্রমণ করেছি বলে মিথ্যা এনকাউন্টার না করতে পারে।
প্রশ্নঃ সিএএ বা নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন নিয়ে কি বলবেন?
উত্তরঃ অন্যদেশ থেকে এসে এদেশে বসবাস করা হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ, খ্রিস্টানদের নাগরিকত্ব দেওয়া হলে ভালই হবে। তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে চাইবো না প্রতিবেশী বাংলাদেশ থেকে হিন্দুরা নির্যাতিত হয়ে দলে দলে সবাই অসমে চলে আসুক। তাহলে ওদেশের বিখ্যাত ঢাকেশ্বরী মন্দির-সহ আরও সব মন্দির দেখাশোনা করবে কে? বরং চাইবো, সম্পূর্ণ নিরাপদে থাকুন বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দুরা। ভারত সরকার কেন হিন্দুদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করবে না। কই, সেটা তো কোন দিন করেনি। আসলে এরা মুহূর্তে হিন্দুত্বের কথা বলে। হিন্দুদের কথা ভাবে না।
তাছাড়া নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বিশেষ কার্যকরি করা হবে না। বলা হচ্ছে, অসম ছাড়া উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অন্য কোনও রাজ্যে করা হবে না। নাগাল্যান্ড, মিজোরাম এবং মেঘালয়ের ৩/৪টি বিধানসভা এলাকা ছাড়া এই আইনের প্রয়োগ হবে না। বাস্তব হল, এই সরকারই চায় না নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন চালু হোক। চাইলে বিল পাশ হওয়ার পর এতোগুলো বছর পার হলেও কেন আইনের রুল তৈরি হলো না? অসমে এখনও কেন বাঙালি হিন্দুদের সন্দেহভাজন বিদেশির নোটিশ পাঠিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে?
প্রশ্নঃ অসমের মাদ্রাসা শিক্ষা কি সরকার পুরোপুরি তুলে দিল? ভবিষ্যৎ কি মাদ্রাসাগুলির?
উত্তরঃ অসমের সব সরকারি মাদ্রাসা সরকার বন্ধ করে দিয়ে সেখানে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলে রুপান্তর করেছে। এটা সরকারের এক্তিয়ারের বাইরে। কারণ মাদ্রাসাগুলি জমি কিনে ভবন নির্মাণ করেছেন মুসলমানরাই। পরে সরকার মাদ্রাসাগুলিকে সরকারীকরণ করেছে। আগে বিজেপি সরকারেরই মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী মুরলি মনোহর যোশী মাদ্রাসাগুলি আধুনিকীকরণে জোর দিয়ে ছিলেন। হিমন্ত বিশ্ব শর্মা সেই পথ অনুসরণ করলেই ভাল করতেন। মাদ্রাসাগুলি বন্ধ করে দেওয়ায় বিশেষ করে ক্ষতিগ্রস্থ হবে মুসলিম নারী শিক্ষা। যারা হিযাব পরে মাদ্রাসায় যাওয়ায় অভ্যস্ত তারা অন্য স্কুলে পড়তে যাবে না হিযাব ছাড়া। কারণ সরকারি স্কুলে হিযাব বাধাপ্রাপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা।
প্রশ্নঃ এবার অসমে চরম বিধিনিষেধের মধ্যে কুরবানি ঈদ কেমন হবে বলে আপনি মনে করেন?
উত্তরঃ বিজেপি সরকার মুসলিমদের ভালো চোখে দেখে না, মুসলিমদের ধর্মীয় উৎসবকেও না। প্রতি বছরই দেূা যায় কুরবানিকে কেন্দ্র করে ছোটখাটো ঝুটঝামেলা লেগে থাকে। এবার আবার বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে গবাদি পশু কুরবানি দিতে। কারণ, সরকারের আনা গো-সুরক্ষা আইন। এই আইনে উল্লেখ রয়েছে কোনও মন্দির এবং নামঘরের পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে গরু জবাই কিংবা বিক্রি নিষিদ্ধ। অসমে এমন কোনও জায়গা নেই, যেখানে পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে কোনও মন্দির বা নামঘর নেই। সুতরাং সবটাই মুসলিমদের চাপে রাখার কৌশল।
রীতি অনুযায়ী প্রিয় পশুর কুরানি দিতে হয়। কৃষিজীবী মুসলিমদের কাছে প্রিয় গবাদি পশু। সুতরাং তারা এবার আর প্রিয় পশুর কুরবানি দিতে পারবেন না। তাদের বিকল্প পশুকেই কুরানির জন্য বেছে নিতে হবে।