নূপুর থাপলিয়াল: প্রায়শই দেখা যায়, ট্যুইটার ব্যবহারকারীরা সতর্কীকরণ হিসেবে নিজেদের পরিচয়ের সঙ্গে লিখে রাখেন,’রিট্যুইট এনডোর্সমেন্ট নয়’। কিন্তু এই ঘোষণা কি কাউকে ফৌজদারি দায় থেকে মুক্তি দিতে পারে? সম্প্রতি দিল্লি পুলিশের ডেপুটি কমিশনার কেপিএস মলহোত্রা বলেছেন, ব্যক্তিকে রিট্যুইটের দায় নিতে হবে এবং রিট্যুইটের বক্তব্যই সামাজিক মাধ্যমে যিনি শেয়ার করছেন তাঁর বক্তব্য হয়ে ওঠে। এরই সঙ্গে ডিসিপির মন্তব্য,”যদি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আপনি কোনও মতামত এনডোর্স করেন, তখন সেটাই আপনার মতামত হয়ে যায়। রিট্যুইট করে আমি জানি না বললে হবে না। দায়িত্ব আপনার। সময়টা বড় কথা নয়। আপনি যখনই কোনও কিছু রিট্যুইট করছেন, তখনই সেটা নতুন। আমাদের নজরে যখন কিছু পড়ে, তারই ভিত্তিতে পুলিশি পদক্ষেপ নেওয়া হয়।”
এখন আমাদের প্রশ্ন হল, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কোনও পোস্ট রিট্যুইট করা বা ফরোয়ার্ড করা কি ফৌজদারি অপরাধ?
ভারতীয় আইনে সরাসরি এমন কোনও বিধি নেই যেখানে বলা হয়েছে যে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কিছু রিট্যুইট, ফরোয়ার্ড বা শেয়ার করা ফৌজদারি অপরাধ। তথ্য প্রযুক্তি আইন ও ভারতীয় দণ্ডবিধিতে কিছু ফৌজদারি দায়বদ্ধতার কথা বর্ণনা করা হয়েছে। আইটি আইনের ৬৭ ধারায় বিদ্যুতিন আঙ্গিকে অশ্লীল কিছু প্রকাশ বা প্রচার করার জন্য শাস্তির নিদান দেওয়া হয়েছে। তিন বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড ও জরিমানার উল্লেখ রয়েছে।
দ্বিতীয় বার এমন অপরাধ করলে পাঁচ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড ও সেই সঙ্গে জরিমানা দিতে হবে। একই ভাবে এই আইনের ৬৭এ ধারায় বলা রয়েছে, বৈদ্যুতিন আঙ্গিকে শিশুদের যৌন বিষয় স্পষ্টভাবে রয়েছে এমন কিছু প্রকাশ বা প্রচার করলে শাস্তি হবে। পাঁচ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড ও জরিমানা। দ্বিতীয়বার এই কাজ করলে কারাদণ্ডের মেয়াদ বেড়ে সাত বছর হতে পারে এবং সেই সঙ্গে জরিমানা। তথ্য প্রযুক্তি আইন ছাড়াও ভারতীয় দণ্ডবিধি বা আইপিসিতে নির্দিষ্ট করে কিছু নিয়মের কথা বলা হয়েছে। সাইবার পরিসরে কোনও ব্যক্তির বিরুদ্ধে কদর্য ও আক্রমণাত্মক বার্তা পাঠানো হলে বা শেয়ারা করা হলে লাগু হতে পারে ১৫৩এ, ১৫৩বি, ২৯২এ, ২৯৫এ, ৪৯৯ ইত্যাদি ধারা। সাম্প্রদায়িক ঘৃণা ছড়ানো, অশ্লীলতা, কারও ধর্মানুভূতিতে আঘাত দেওয়া বা অবমাননা করা ইত্যাদি অপরাধের মধ্যে পড়ে।
২০১৭ সালে, আম আদমি পার্টির নেতা রাঘব চাড্ডার পিটিশন বাতিল করে দিয়েছিল দিল্লি হাইকোর্ট। তৎকালীন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অরুণ জেটলি তাঁর বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করেছিলেন এবং সেই মামলাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে পিটিশন দায়ের করেছিলেন চাড্ডা। রিট্যুইট করা ভারতীয় দণ্ডবিধির ৪৯৯ ধারার আওতায় পড়বে কিনা তা সিদ্ধান্ত নিতে ট্রায়াল আদালতে বিষয়টি পাঠানো হয়েছিল।
পর্যবেক্ষণে বলা হয়, যিনি রিট্যুইট করেন, তাঁর ফলোয়ারদের কাছে তৎক্ষণাৎ উঠে আসে মূল ট্যুইটটি এবং সেটি তাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে।
বিচারপতি সঙ্গীতা ধিংড়ার পর্যবেক্ষণ, রিট্যুইট ফৌজদারি দায়ের মধ্যে পড়বে কিনা তা স্থির হবে মামলার কার্যপ্রণালী চলার সময়।
২০১৮ সালে, মাদ্রাজ হাইকোর্ট রায় দেয়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কোনও বার্তা শেয়ার করা বা ফরোয়ার্ড করা মূল বার্তাকে গ্রহণ ও এনডোর্স করার সমতুল। ফলত, সাংবাদিক থেকে রাজনীতিতে আসা বিজেপির নেতা এস ভি শেখরের অন্তর্বর্তী জামিনের আবেদন খারিজ করে দেওয়া হয়।
প্রসঙ্গত, শেখর মহিলা সাংবাদিকদের নিয়ে এক কদর্য ফেসবুক পোস্ট শেয়ার করেছিলেন। সেই সময় আদালত বলেছিল,”মহিলাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করার অধিকার কারও নেই এবং যদি তা করা হয় তাহলে সেটি অধিকারের উল্লঙ্ঘন। কাউকে তার সম্প্রদায়ের নাম ধরে ডাকাটাই একটা অপরাধ। এই ধরনের অসংসদীয় শব্দ ব্যবহার করাই মারাত্মক। কাজের চেয়ে শব্দ বেশি শক্তিশালী। যখন কোনও সেলিব্রিটিতুল্য ব্যক্তি এই রকম বার্তা ফরোয়ার্ড করেন, তখন সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করে যে, এই ধরনের ক্রিয়াকলাপ ঘটছে।” আদালতের এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে শেখরের বিশেষ ‘লিভ’ পিটিশনকেও ২০১৮ সালের ১ জুন বাতিল করে দেয় সর্বোচ্চ আদালত যেহেতু রাজ্য জানিয়েছিল যে, এই বিষয়ে চার্জশিট জমা দেওয়া হয়েছে।
সুতরাং আদালত বলে, শেখর হাজির হবেন ট্রায়াল কোর্টে এবং সেখান থেকেই তিনি সাধারণ জামিন চাইতে পারেন। তাই, কোনও পোস্ট ফরোয়ার্ড করাটা ফৌজদারি অপরাধ কিনা, এই বৃহত্তর প্রশ্নটির উত্তর এখনও মেলেনি।
এই বিষয়ে প্রতিনিধিত্বমূলক, সুনির্দিষ্ট রায় বা প্রত্যক্ষ বিধি না থাকায় এটা স্পষ্ট যে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কোনও পোস্ট ফরোয়ার্ড বা শেয়ার করা ফৌজদারি অপরাধ কিনা তা সম্পূর্ণ ভাবে সিদ্ধান্ত নেবে আদালত। এই জাতীয় প্রতিটি মামলার তথ্য ও পরিস্থিতি খতিয়ে দেখে বিবেচনা করবে তারা।
রাঘব চাড্ডা মামলায় দিল্লি হাইকোর্টের যুক্তি থেকে প্রতীয়মাণ হয় যে, রিট্যুইট করা ভারতীয় দণ্ডবিধির আওতায় অবমাননার দায়ে পড়বে কিনা তা স্থির করতে হবে ট্রায়াল আদালতকেই।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অন্যের পোস্ট রিট্যুইট, শেয়ার বা ফরোয়ার্ড করাকে যদি ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য করতে হয়, তাহলে আইনি কাঠামোকে তার বর্তমান ধূসর জায়গাকে পূরণ করতে হবে। আইন প্রয়োগকারী এজেন্সিগুলি এই আইনকে কোনও ভাবে যাতে অপব্যবহার করতে না পারে, সেই জন্য আইনের ঘাটতির দিকটি পূরণ করা প্রয়োজন।
যিনি মূল ট্যুইট করেছেন এবং যিনি সেটি রিট্যুইট, শেয়ার বা ফরোয়ার্ড করেছেন, তাদের মধ্যে স্পষ্ট কোনও বিভেদরেখা না থাকায়, দ্বিতীয় পক্ষের সঙ্গে তেমন আচরণই করা হতে পারে যেমনটা প্রথম পক্ষের সঙ্গে করা হয়েছে।