শেখ কুতুবউদ্দিন: এই দুঃসময়েও শোনা গেল শান্তি ও সংহতির স্নিগ্ধ কণ্ঠ। এই আওয়াজ এল নোবেলজয়ী অর্থনীতি বিশেষজ্ঞ ও চিন্তাবিদ অমর্ত্য সেনের কাছ থেকে। বৃহস্পতিবার ছিল সল্টলেকে প্রতীচী ট্রাস্টের অমর্ত্য সেন রিসার্চ সেন্টারের উদ্বোধন। এই অনুষ্ঠানে অমর্ত্য সেন ভারতের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে কোনও রাখঢাক না রেখেই বলেন, দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে আমি ভীত, আমি ভয় পাচ্ছি। ভয় পাওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। আমি চাই দেশ আগের মতোই ঐক্যবদ্ধ থাকুক। সেজন্য আমাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। এটা দেশবাসীর আরও বেশি করে বোঝা দরকার।
‘ব্যাক টু স্কুল’ শীর্ষক আলোচনায় অমর্ত্য সেন দীর্ঘ বক্তব্য রাখেন। এই আলোচনায় আরও ছিলেন অনীতা রামপাল, জিন ড্রিজ, শ্রীনাথ রেড্ডি ও এ কে শিবকুমার।
প্রবীণ এই নোবেলজয়ী দেশের বর্তমান অবস্থার দিকে লক্ষ্য রেখে আরও বলেন, ভারতবর্ষ শুধুমাত্র হিন্দুর ভারতবর্ষ হতে পারে না। শুধুমাত্র মুসলিমেরও ভারতবর্ষ হতে পারে না। সবাইকে একসঙ্গে থাকতে হবে। সেটাই ভারতের ঐতিহ্য ও গরিমার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। অমর্ত্য সেন আরও বলেন, দেশের বিচারব্যবস্থার দিকেও নজর দিতে হবে। বিচারব্যবস্থার দিকে তাকিয়ে থাকেন সাধারণ মানুষ। কিন্তু অনেককে আটক করা হয় আইনের অপব্যবহার করে।
আলোচনার শুরুতেই ভারতে বিভিন্ন ধর্ম সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্যের ইতিহাসের কথা তুলে ধরেন অমর্ত্য সেন। তিনি বলেন, ভারতে সহিষ্ণুতার ইতিহাস রয়েছে। ইহুদিরা ভারতে এসেছে, খ্রিস্টানরা এসেছে। তার আগে ও পরেও অনেকে ভারতে এসেছেন, আমরা সহিষ্ণু ছিলাম। তিনি এ বিষয়ে উদাহরণ দেন প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের। সেখানে ওঠে অলবিরুনী ও আর্যভট্টের কথা। অমর্ত্য বলেন, ভারতের বিজ্ঞানচর্চার ইতিহাসে এক সমন্বয়ের ইতিহাস রয়েছে। কিন্তু জাতপাতকে সামনে রেখে দেশভাগের চেষ্টা চলছে বলে তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
‘তোমরা যে সব বুড়ো খোকা ভারত ভেঙে ভাগ করো!’ দেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি বোঝাতে অন্নদাশঙ্কর রায়ের বিখ্যাত কবিতার পংক্তি হাতিয়ার করলেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন। ধর্মীয় বিভাজনের মাধ্যমে একশ্রেণির মানুষ যেভাবে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে টুকরো-টুকরো করার চেষ্টা করছে, তার বিরুদ্ধে সরব হলেন তিনি। ভাষণে উঠে এল ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাতের প্রসঙ্গও।
বিচারব্যবস্থা ও আমলাতন্ত্রের মধ্যে ভারসাম্য রাখা দরকার, স্মরণ করালেন সে-কথাও।
নবী সা.-এর অবমাননা নিয়ে এ দিন সরব হলেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন। নোবেলজয়ী বলেন, যে দেশে এত বছর ধরে হিন্দু-মুসলিম একসঙ্গে বসবাস করছে, সেই দেশে মুসলিমদের বারবার আক্রমণ করা হচ্ছে। মুসলিম সম্প্রদায়ের ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত করা হচ্ছে। এই দেশে রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের জন্ম, তাঁরা একসঙ্গে থাকার বার্তা দিয়েছেন।
রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, নেতাজি আমাদের ঐক্যের শিক্ষা দিয়েছেন। মানুষকে একসঙ্গে রা’তে সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন। সেই দেশে মানুষে মানুষে বিভেদ-বিদ্বেষের চেষ্টা করা হচ্ছে। এভাবে দেশের উন্নয়ন হতে পারে না, এটা উন্নয়নের উপর আঘাত মাত্র। স্বাধীনতার আগে ও পরে বিভিন্নভাবে সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান ঘটেছে।
এ দেশের স্মৃতি-সৌধগুলিতে ধর্ম নির্বিশেষে বিভিন্ন মানুষের সমন্বয় রয়েছে। সেই জায়গায় এক শ্রেণি মানুষের ভাবাবেগে আঘাত হানা হচ্ছে, ইতিহাসকে পালটে দেওয়া হচ্ছে। এভাবে কোনও দেশের উন্নয়ন হতে পারে না। তিনি বলেন, ভারতের মানুষ এক সঙ্গে থাকতে চান, একসঙ্গে কাজ করতে চান। এক কথায়, যুক্ত সাধনা, অথবা ‘ওয়ার্কিং টুগেদার’। কিন্তু জাতপাতকে সামনে রেখে দেশে বিভাজনের চেষ্টা চলছে। এটা জাতির জন্য ভয়ংকর।
ভারতে বিভিন্ন ধর্ম ও সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্যের ইতিহাসের কথা উল্লেখ করে অমর্ত্য সেন বলেন, যে দেশ ঐতিহাসিকভাবে উদার ছিল, সেই দেশে এমন পরিস্থিতি হবে ভাবতে পারি না। দেশে শুধু সহিষ্ণুতা নয়, ঐক্য চাই। বৈদিক অঙ্ক শাস্ত্রের কথাও তোলেন তিনি।
দেশের ঐক্য নিয়ে বলতে গিয়ে বারবার ইতিহাস টেনে এনে তিনি বলেন, ভারত শুধু হিন্দু সংস্কৃতির দেশ নয়, মুসলিমরাও ভারতের অংশ। তার প্রমাণ তাজমহল। আমার মনে হয় না হিন্দুরা এককভাবে তাজমহল তৈরি করার কৃতিত্ব নিতে পারেন। রবিশংকর-আলি আকবর খানের সাধনা এর প্রকৃত উদাহরণ। বিভাজন উপেক্ষা করলে হবে না। শুধু সহিষ্ণুতার কথা বললেও হবে না।’
তিনি নিজের ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ প্রকাশ করে বলেন, ‘আমাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ রয়েছে। আমাদের সহিষ্ণুতার ইতিহাস আজও রয়েছে। কিন্তু সেই পরিস্থিতি ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে।’
অন্নদাশঙ্কর রায়ের পংক্তি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘তেলের শিশি ভাঙল বলে/ খুকুর ‘পরে রাগ করো/ তোমরা যে সব বুড়ো খোকা/ ভারত ভেঙে ভাগ করো!/ তার বেলা?
‘অন্যায় যে করে অন্যায় যে সহে, তব ঘৃণা যেন তারে তৃণসম দহে’।—এই পংক্তি ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, দেশের যা পরিস্থিতি চলছে, তাতে সম্মিলিতভবে রুখে দাঁড়াতে হবে। কারণ আমরা দেশের শান্তি চাই, দেশের উন্নয়ন চাই। কারণ দেশ আর্থিকভাবেও পিছিয়ে যাচ্ছে। এতে সাধারণ মানুষকেই ভুগতে হচ্ছে। দেশে ‘হিন্দুত্ব’ ছাড়া কোনও কিছু হচ্ছে না। তাই এইসব ছেড়ে মানুষের কল্যাণে মানুষকেই এগিয়ে আসার পরামর্শ দেন তিনি।
এ দিনের প্রথম পর্বের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন মন্ত্রী শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়, অর্থনীতিবিদ ও প্রাক্তন মন্ত্রী অসীম দাশগুপ্ত প্রমুখ।
এ দিন স্বাস্থ্য, শিক্ষা প্রভৃতি বিষয় নিয়েও আলোচনা হয়। এই গবেষণা কেন্দ্র থেকে এই সমস্ত বিষয়ের নতুন নতুন তথ্য ও গবেষণার কাজ চালানো হবে।