মহম্মদ নিহাদ পিভি: গুজরাত পুলিশের সন্ত্রাসবিরোধী স্কোয়াড (এটিএস) প্রখ্যাত সমাজকর্মী তিস্তা শেতলবাদকে তাঁর মুম্বইয়ের বাড়ি থেকে আটক করার পর বহু আন্তর্জাতিক অধিকার সংগঠন ও রাষ্ট্রপুঞ্জের আধিকারিকরা তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। আহমেদাবাদ ক্রাইম ব্রাঞ্চ শেতলবাদের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করেছিল। তারই ভিত্তিতে তাঁকে আটক করা হয়। শেতলবাদকে আহমেদাবাদে নিয়ে যাওয়া হয় এবং তারপর তাঁকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ২০০২ সালের গোধরা দাঙ্গা মামলায় সুপ্রিম কোর্ট তৎকালীন গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ছাড়পত্র দেওয়ার পরই শেতলবাদের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করা হয়েছিল। রাষ্ট্রপুঞ্জের এক আধিকারিক তিস্তার গ্রেফতারি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে আশু তাঁর মুক্তির দাবি জানিয়েছেন।
রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার প্রতিরক্ষা বিষয়ক বিশেষ প্রতিনিধি ম্যারি ললোর ট্যুইট করে মন্তব্য করেছেন,”ঘৃণা ও বৈষম্যের বিপ্রতীপে তিস্তা জোরালো কণ্ঠস্বর। মানবাধিকার রক্ষা করা কোনও অপরাধ নয়।” অ্যামনেস্টি ইন্ডিয়া তিস্তার গ্রেফতারিকে ‘প্রত্যক্ষ প্রতিহিংসা’ বলে অভিহিত করেছে। তাদের মতে, যারা ভারত সরকারের মানবাধিকার সংক্রান্ত রেকর্ডকে প্রশ্ন করছে, তাদের বিরুদ্ধেই এই ধরনের দমনপীড়নমূলক পদক্ষেপ নিচ্ছে সরকার। মানবাধিকার রক্ষার আন্তর্জাতিক সংগঠন ফ্রন্টলাইন ডিফেন্ডার জানিয়েছে,”গুজরাত অ্যান্টি টেরর পুলিশ জোর করে তিস্তার বাড়িতে প্রবেশ করে এবং কোনও কারণ ছাড়াই তাঁকে আটক করে। তাঁর আশু মুক্তির ডাক দিচ্ছি আমরা। শান্তিপূর্ণভাবে যাতে তিনি মানবাধিকার রক্ষার কাজ করে যেতে পারেন, সে জন্য তাঁর বিরুদ্ধে চলা আইনি বিচার বন্ধ হোক।” এখন প্রশ্ন হল, কে এই তিস্তা শেতলবাদ?
তিস্তা শেতলবাদ একজন সাংবাদিক ও সমাজকর্মী। সিটিজেনস ফর জাস্টিস অ্যান্ড পিসের (সিজেপি) সেক্রেটারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এই সংগঠন ২০০২ সালে গুজরাতে মুসলিম গণহত্যায় বেঁচে যাওয়া মানুষদের আইনি ও আর্থিকভাবে সহযোগিতা করে। তাঁর স্বামী জাভেদ আনন্দও সাংবাদিক এবং নাগরিক অধিকার রক্ষা কর্মী। এই দম্পতি সবরং কমিউনিকেশনের হয়ে ‘কমিউনালিজম কমব্যাট’ নামে একটি মাসিক পত্রিকা সম্পাদনা করেন। জাকিয়া জাফরি মামলায় উভয়েই ছিলেন সহ-পিটিশনার। গণহত্যা চলাকালীন জাফরির স্বামী প্রাক্তন কংগ্রেস সাংসদ এহসান জাফরিকে খুন করে উন্মত্ত হিন্দুত্ববাদী জনতা। পিটিশনে দাবি করা হয়েছিল, তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও আরও ৬৩ জন শীর্ষ নেতাকে গোটা ঘটনার জন্য দায়ী করা হোক। উল্লেখ করা হয়, গোধরায় ট্রেন অগ্নিদগ্ধ হওয়ার পর এই রাজ্যে সাম্প্রদায়িক অস্থিরতা তৈরি করতে অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল। গুজরাতে গণহত্যার কয়েক মাস পরে, ২০০২ সালের ১০ জুন আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতা বিষয়ে ইউনাইটেড নেশনস কমিশনে বক্তৃতা করেছিলেন শেতলবাদ। সেই বক্তৃতায় হিংসা ঘটানোয় নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন গুজরাত সরকারের ভূমিকার সমালোচনা করেছিলেন তিনি।
এই মামলায় তিনি যখন সক্রিয়ভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েন, তখন থেকেই তিনি অনেকের চক্ষুশূল হয়ে ওঠেন এবং বহুবার তাঁকে থামানোর চেষ্টা করা হয়েছে। বেস্ট বেকারি মামলার গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যক্ষদর্শী জাহিরা শেখকে নির্দিষ্ট কিছু মন্তব্য করতে প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগে ২০০৪ সালের নভেম্বর মাসে তিস্তার বিরুদ্ধে চার্জ আনা হয়। পরে, ২০০৫ সালের আগস্টে সেই অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হয় এবং সুপ্রিম কোর্ট অফ ইন্ডিয়া কমিটি তাঁকে ছাড়পত্র দেয়। গুজরাত গণহত্যার চক্রীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুখ হয়ে উঠেছিলেন শেতলবাদ। নতুন করে তদন্ত শুরু করতে সুপ্রিম কোর্টকে বাধ্য করেন তিনি। এহসান জাফরি ও আরও ৬৮ জনের হত্যা নিয়ে চলা গুলবার্গ মামলার পাশাপাশি সিজেপির সহযোগিতায় জাকিয়া জাফরির পিটিশনে দাবি করা হয়, শীর্ষ নেতা, আধিকারিক, গুজরাতের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, অন্যান্য ক্যাবিনেট মন্ত্রী, বিশ্ব হিন্দু পরিষদের নেতা প্রবীণ তোগাড়িয়া ও জয়দীপ প্যাটেল, তৎকালীন ডিজিপি পি সি পান্ডেদের ফৌজদারি বিচার হোক। এই নৃশংস ষড়যন্ত্রে যুক্ত থাকার অভিযোগে মোদির বিরুদ্ধে পৃথকভাবে এফআইআর দায়ের করেন শেতলবাদ।
তাঁর পিটিশনের ভিত্তিতে ২০০৯ সালে সুপ্রিম কোর্ট নিযুক্ত সিট গঠন করা হয়। তিন বছর পর, ২০১২ সালে, এক ট্রায়াল বিচারপতি উল্লেখ করেন যে, মোদি, অন্যান্য প্রথম সারির সরকারি কর্মী বা আমলাদের বিরুদ্ধে চার্জ আনার মতো কোনও প্রমাণ খুঁজে পায়নি সিট। ২০১৩ সালে, জাকিয়া জাফরি ও শেতলবাদের সিজেপি একটি প্রতিবাদী পিটিশন দায়ের করেন। সেই ভয়াবহ ঘটনার ১৪ বছর পর, ২০১৬ সালে, বিচারে ২৪ জন দোষী সাব্যস্ত হয়। ১১ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা হয়, ১ জনের ১০ বছরের কারাদণ্ড হয় এবং বাকি ১২ জনের সাত বছর সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। তবে, আদালত ও সিট জোর দিয়ে বলে যে, ব্যক্তিগতভাবে এহসান জাফরি গুলি চালানোয় জনতা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে, আর তাই গোটা বিষয়টা হাতের বাইরে চলে যায়। তাই, এই রায় জাকিয়া জাফরি বা সিজেপির জয় নয়। সিটের তদন্তকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে মামলা করেন তাঁরা। সেই তদন্তকে পুনরায় পর্যালোচনা করার আবেদনে সুপ্রিম কোর্ট অবশেষে সম্মতি জানিয়েছিল। দীর্ঘ লড়াইয়ের পর সিটের দেওয়া ক্লিন-চিটের তদন্ত হয়। নরেন্দ্র মোদি সহ অন্যান্য উচ্চপদস্থ আধিকারিক ও নেতাদের বিরুদ্ধে যে বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তোলা হয়েছিল তা চলতি বছরের ২৪ জুন খারিজ করে দেয় সুপ্রিম কোর্ট। ফলত, সেই পিটিশনও বাতিল হয়ে যায়।
দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এক সাক্ষাৎকারে নির্দিষ্টভাবে তিস্তা ও তাঁর এনজিওকে আক্রমণ করেন। এর আগেও তিস্তা বহু ঝামেলায় পড়েছেন এই মামলায় সহযোগিতা করার জন্য। তাঁর বিরুদ্ধে ফেক ভিডিও তৈরি করা, গোরস্থানে অনুপ্রবেশ, প্রত্যক্ষদর্শীদের শিখিয়ে-পড়িয়ে দেওয়া এবং আইনি ব্যবস্থার অপব্যবহারের অভিযোগ ওঠে। নরেন্দ্র মোদিকে ‘যথেষ্ট প্রমাণ’ ছাড়া অপমান করার ‘অপরাধে’ তিনি বহুবার বিজেপির দ্বারা আক্রান্ত হয়েছেন। এমনকি এই অভিযোগও তোলা হয়, শেতলবাদের সবরং কমিউনিকেশন ফরেন কন্ট্রিবিউশন রেগুলেশন আইনে (এফসিআরএ) নথিভুক্ত না হওয়া সত্ত্বেও এবং কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ব্যতীত আমেরিকা-ভিত্তিক ফোর্ড ফাউন্ডেশন থেকে অনুদান নিয়েছে। এক এফআইআরের ভিত্তিতে তাঁকে ও দুই প্রাক্তন আইপিএস আধিকারিক–আর বি শ্রীকুমার, সঞ্জীব ভাটকে আটক করা হয়েছে এবারে। গ্রেফতারির পরেই শেতলবাদ সান্তা ক্রুজ থানায় তাঁর হেফাজতের প্রকৃতি নিয়ে ভাবনাচিন্তার কথা জানিয়েছেন। বিস্তারিত সেই বিবরণে তিনি জানিয়েছেন, গ্রেফতারির আগে সিআইএসএফ নয়ডার এক ব্যক্তি তাঁর সহকর্মীকে ফোন করেছিলেন এবং তাঁর নিরাপত্তা ব্যবস্থা সম্পর্কে খোঁজখবর করেন। সেই অজ্ঞাত পরিচয় ফোন কলের আধ ঘন্টার মধ্যে বিজেপির রাজ্যসভা সাংসদ নারায়ণ রানের বাংলো থেকে দুই সশস্ত্র সিআইএসএফ আধিকারিক শেতলবাদের বাড়ির দরজায় পৌঁছে যান।
তাঁদের সঙ্গে ৮-১০ জন এটিএস আধিকারিক যোগ দেন এবং শেতলবাদের বাড়ির চত্বরে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়েন। তাঁরা শেতলবাদকে হেনস্থা করেন এবং কোনও কারণ বা ওয়ারান্ট না দেখিয়ে জোর করে হেফাজতে নেন তাঁকে। হাতে লেখা এক অভিযোগে তিনি জানান,”আমার প্রাণের গুরুতর সংশয় রয়েছে কারণ, গুজরাত রাজ্য পুলিশের প্রতিহিংসা।” গুজরাত এটিএস এরপর আহমেদাবাদ ক্রাইম ব্রাঞ্চের হাতে তুলে দেয় তাঁকে। জালিয়াতি, অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র, অন্যকে আহত করতে ফৌজদারি বিচারকে অপমান ইত্যাদির সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, তিস্তা শেতলবাদ অজস্র জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সম্মান পেয়েছেন দীর্ঘ কর্মজীবনে। আউটস্ট্যান্ডিং উইমেন মিডিয়া পার্সন হিসেবে ১৯৯৩ সালে চামেলি দেবী জৈন অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন। ১৯৯৯ সালে মহারানা মেওয়ার ফাউন্ডেশন তাঁকে হাকিম খান সুর অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত করে। ২০০০ সালে দলিত লিবারেশন এডুকেশন ট্রাস্ট তাঁকে দেয় হিউম্যান রাইটস অ্যাওয়ার্ড। ২০০৩ সালে পেয়েছেন নুরেমবার্গ ইন্টারন্যাশনাল হিউম্যান রাইটস অ্যাওয়ার্ড। ২০০৭ সালে ভারত সরকার তাঁকে পদ্মশ্রী সম্মানে অলংকৃত করে।