ইউক্রেনকে ঘিরে রাশিয়া ও ন্যাটো জোটের মধ্যে যুদ্ধ কি শীঘ্রই শুরু হবে? ইউক্রেন ছিল সোভিয়েত রাশিয়ারই একটি অঙ্গরাজ্য। সোভিয়েতের পতনের পর রাশিয়ার যে ক’টি প্রদেশ রাষ্ট্রে পরিণত হয়, ইউক্রেন তার মধ্যে অন্যতম। কিন্তু ইউক্রেনকে নিয়ে কেন মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটো জোট এবং পুতিনের রাশিয়া যুদ্ধের মুখোমুখি হয়েছে, সেই সংকটের ইতিহাস ও বর্তমান পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করা হয়েছে এই নিবন্ধে। আজ প্রথম কিস্তি। একটি বিদেশি সংবাদমাধ্যমের জন্য নিবন্ধটি লিখেছেন মোয়াজ্জেম হোসেন
ইউক্রেনকে ঘিরে ইউরোপে উত্তেজনা এখন চরমে। এর একদিকে আছে রাশিয়া, যারা ইউক্রেনের সীমান্তে প্রায় লাখখানেক সৈন্য সমাবেশ ঘটিয়েছে বলে দাবি করছে পশ্চিমা দেশগুলো। এর পালটা ন্যাটো জোটও তাদের সামরিক তৎপরতা বাড়িয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের সময় যেভাবে আমেরিকা বা ইউরোপের সঙ্গে ওই দেশের ঠান্ডা লড়াই লেগে থাকত, কিউবা সংকটের সময় দুই সামরিক পরাশক্তি পরমাণু যুদ্ধের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছিল, বর্তমান অবস্থাও সেই রকম বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
ইউক্রেন দখল করার চেষ্টা করলে রাশিয়ার বিরুদ্ধে কঠোর নিষেধাজ্ঞা-সহ নানা ব্যবস্থার হুমকি দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্ররা। গত বেশ কয়েক দশকের মধ্যে এই প্রথম ইউরোপ আবার একটি বড় আকারের যুদ্ধের মুখোমুখি, এমন আশংকা করছেন অনেকে। কিন্তু ইউক্রেনকে ঘিরে এই উত্তেজনা এবং সংঘাত আসলে কেন? রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন আসলে কী চান? ন্যাটো জোটই বা কী করছে? ইউক্রেন সংকট নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রশ্নের উত্তর¬ দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে এই নিবন্ধে।
রাশিয়া কি সত্যিই ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে?
রাশিয়া বার বার জোর গলায় এমন কোনও পরিকল্পনার কথা অস্বীকার করছে যে তারা ইউক্রেনে একটি যুদ্ধ শুরু করার প্রস্তুতি নিয়েছে। তবে রাশিয়া আগেও ইউক্রেনের সীমানা দখল করেছে। এই মুহূর্তে তাদের প্রায় এক লাখ সৈন্য ইউক্রেনের সীমান্তের কাছে মোতায়েন আছে বলে মনে করা হচ্ছে। রাশিয়া বহুদিন ধরেই চেষ্টা করছে, ইউক্রেন যাতে কোনওভাবেই ইউরোপীয় ইউনিয়নে না যায়। রাশিয়ার প্রভাব বলয়ের মধ্যেই যেন অবস্থান করে।
রাশিয়ার আরও আপত্তি ন্যাটো জোট নিয়ে। ইউক্রেন এখনও ন্যাটো জোটের সদস্য নয়। কিন্তু পূর্ব ইউরোপের আরও অনেক সাবেক কমিউনিস্ট দেশের মতো, ইউক্রেনও সেই পথে চলেছে বলে মনে করছে রাশিয়া। সাড়ে আট হাজার মার্কিন সৈন্য প্রস্তুত, রাশিয়া উদ্বিগ্ন। এই মূহূর্তে সেখানে তীব্র সামরিক উত্তেজনা রয়েছে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন হুঁশিয়ারি দিয়েছেন যে, পশ্চিমা দেশগুলো যদি তাদের আক্রমণাত্মক দৃষ্টিভঙ্গি না বদলায়, তাহলে যথাযথ পালটা সামরিক ও কারিগরী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ন্যাটোর সেক্রেটারি জেনারেল মনে করেন, সংঘাতের বাস্তব সম্ভাবনা আছে। আর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বিশ্বাস করেন, রাশিয়া-ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যাবে। যুক্তরাষ্ট্র বলছে, রাশিয়া কেন ইউক্রেন সীমান্তের কাছে এত সৈন্য পাঠিয়েছে, তার কোনও ব্যাখ্যা তারা দেয়নি। বেলারুশেও রাশিয়ার সৈন্যরা যৌথ সামরিক মহড়ায় অংশ নিচ্ছে। পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ধারণা, রাশিয়া এ বছরের প্রথম ভাগেই কোনও এক সময়ে ইউক্রেনে ঢুকবে।
রাশিয়ার উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী অবশ্য বর্তমান সংকটকে কিউবান ক্ষেপণাস্ত্র সংকটের সঙ্গে তুলনা করেছেন। ১৯৬২ সালের সেই সংকটের সময় যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রায় একটি পরমাণু যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে চলে এসেছিল।
ইউক্রেনকে ঘিরে বর্তমান এই সংঘাতের শুরু কখন থেকে?
যদি সাম্প্রতিক ইতিহাসের কথা বলতে হয়, তাহলে বলতে হবে ২০১৪ সালে। যদিও এই সংকটের আসল কারণ বুঝতে হলে যেতে হবে আরও পিছনে সোভিয়েত আমলে। তখন ইউক্রেন সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ ছিল। পূর্ব ইউরোপের আরও কিছু কমিউনিস্ট দেশ এবং সাবেক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রের মতো, ইউক্রেনেও দু’টি রাজনৈতিক ধারা বেশ স্পষ্ট।
একটি অংশ চায় পশ্চিম ইউরোপের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে, ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দিতে এবং নিজেদের প্রতিরক্ষার জন্য ন্যাটো সামরিক জোটের সদস্য হতে। অপর অংশ রুশ প্রভাব বলয়ে থাকার পক্ষপাতী। কারণ ইউক্রেনের জনসংখ্যার বিরাট অংশ রুশ ভাষাভাষি। তারা জাতিগতভাবেও রুশ। রাশিয়ার সঙ্গে তাদের রয়েছে ঘনিষ্ঠ সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক যোগাযোগ।
২০১৪ সালে ইউক্রেনের রুশপন্থী প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিলেন বিক্ষোভের মুখে। এরপর তাঁকে দেশ ছেড়ে পালাতে হয়। প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ দুই নৌকায় পা দিয়ে চলতে চেয়েছিলেন। তিনি পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে মাখামাখি করছিলেন, কিন্তু আবার মস্কোকেও ভক্তি-শ্রদ্ধা দেখিয়ে চলেছিলেন। কিন্তু তারপরও প্রেসিডেন্ট পুতিন তাঁকে সহ্য করেছেন।
কিন্তু যখন ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে এক বিশাল বাণিজ্য চুক্তি করতে চাইলেন, যা প্রকারান্তরে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যপদ পাওয়ার পথে কয়েক ধাপ এগিয়ে যাওয়া, তখন প্রেসিডেন্ট পুতিন ইউক্রেনের ওপর চাপ বাড়াতে শুরু করলেন।
এরপর যখন ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তির আলোচনা ভেঙে বেরিয়ে এলেন, তখন তাঁর বিরুদ্ধে গণবিক্ষোভ শুরু হয়। তাঁর পতনের পর যারা ক্ষমতায় আসে, তারা এমন কিছু পদক্ষেপ নেয়, যা প্রেসিডেন্ট পুতিনকে ক্ষুব্ধ করে।
ইউক্রেনের ভেতরে যে রুশ অধ্যুষিত অঞ্চল, সেখানে সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু হলে মস্কো তাদের সমর্থন দেয়। এই বিরোদীদের সমর্থনে এরপর রুশ সৈন্যরা হস্তক্ষেপ করে, এক পর্যায়ে রাশিয়া ক্রিমিয়া অঞ্চল দখল করে সেটি নিজেদের দেশের অংশ বলে ঘোষণা করে।
রাশিয়া কেন ক্রিমিয়াকে নিজের সীমানাভুক্ত করল?
রাশিয়া এক বিরাট দেশ, বিশ্বের সবচেয়ে বড় দেশ, ১১টি টাইম জোন জুড়ে যেটি বিস্তৃত। যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিগুণ। ভারতের পাঁচগুণ। ব্রিটেনের চেয়ে ৭০ গুণ বড়। কিন্তু দেশটির জনসংখ্যা মাত্র ১৪ কোটি ৪০ লক্ষ। বাংলাদেশ, নাইজেরিয়া বা পাকিস্তানের চেয়েও কম। এত বড় একটি দেশের ক্রিমিয়া দখল করে নিজের সীমানাভুক্ত করার কী দরকার ছিল, এমন প্রশ্ন উঠতেই পারে।
রাশিয়া যত বড় দেশই হোক, তাদের একটাই সমস্যা, সারা বছর সচল রাখা যায় উষ্ণ জলের এমন গুরুত্বপূর্ণ বন্দর তাদের প্রায় নেই বললেই চলে। ক্রিমিয়ার সেভাস্তাপোলে রাশিয়ার যে নৌঘাঁটি, সেটি কৌশলগত কারণে রাশিয়ার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাল্টিক সাগরে রাশিয়ার ঢোকার পথ হচ্ছে এই বন্দর। সেটি হাতছাড়া করতে তারা কোনওভাবেই চায় না।
প্রায় দুশো বছর ধরে ক্রিমিয়া কিন্তু রাশিয়ারই অংশ ছিল। ক্রিমিয়ার প্রায় ৬০ শতাংশ মানুষও জাতিগত রুশ। ১৯৫৪ সালে সোভিয়েত নেতা নিকিতা ত্রুশ্চেভ এটি হস্তান্তর করেন তৎকালীন সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র ইউক্রেনের কাছে। তখন তারা ভাবেননি, কোনও একদিন সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাবে এবং ক্রিমিয়ার ওপর মস্কোর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে যাবে।
কাজেই ইউক্রেন যে ন্যাটোর সদস্য হবে, সেটা রাশিয়া কোনওভাবেই মানতে চায় না। কিন্তু মস্কো যখনই দেখল যে ইউক্রেন তাদের প্রভাবের বাইরে চলে যাচ্ছে, তখন প্রেসিডেন্ট পুতিন সেখানে হস্তক্ষেপ করার সিদ্ধান্ত নেন।
লেখক-সাংবাদিক টিম মার্শালের মতে, কোন বৃহৎ শক্তির অস্তিত্ব যখন হুমকিতে পড়ে, তখন সে শক্তি প্রয়োগ করবেই। এটা হচ্ছে কূটনীতির এক নম্বর শিক্ষা। তিনি তাঁর একটি বই ‘প্রিজনার্স অব জিওগ্রাফি’-তে লিখেছেন, আপনি হয়তো এরকম একটা যুক্তি দিতে পারেন যে, প্রেসিডেন্ট পুতিনের সামনে বিকল্প ছিল। তিনি ইউক্রেনের ভৌগোলিক অখণ্ডতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে পারতেন। কিন্তু মনে রাখতে হবে, প্রেসিডেন্ট পুতিন আসলে রাশিয়ার ঈশ্বর প্রদত্ত ভৌগোলিক হাত নিয়ে খেলছেন এখানে। কাজেই ইউক্রেনের ব্যাপারে কিছু না করে বসে থাকার কোনও সুযোগ তাঁর ছিল না। কারণ ক্রিমিয়া রাশিয়ার একমাত্র উষ্ণ পানির বন্দর, আর পুতিনের আমলেই এই বন্দর রাশিয়ার হাতছাড়া হোক, সেটা তিনি চাননি। রাশিয়া নিজেকে এখনও দেখে এক পরাশক্তি হিসেবে এবং বিশ্বে তার সেই সামরিক-রাজনৈতিক শক্তি অটুট রাখার ক্ষেত্রে ক্রিমিয়ার ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব তাই অনেক বিশাল।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটোর কাছে রাশিয়ার দাবি কী?
ইউক্রেন এখনও ন্যাটোর সদস্য নয়। তবে তাদের সঙ্গে ন্যাটোর সখ্যতা আছে। ভবিষ্যতে কোনও একদিন তারা মার্কিন কর্তৃতাধীন ন্যাটো সামরিক জোটের সদস্য হবে, এরকম একটা বোঝাপড়া আছে। তবে রাশিয়া পশ্চিমা দেশগুলোর কাছ থেকে এই নিশ্চয়তা চায়, যেন এটা কখনওই না ঘটে। কিন্তু পশ্চিমা দেশগুলো এই নিশ্চয়তা প্রদানে রাজি নয়।
ইউক্রেনের জনসংখ্যার একটা বড় অংশ জাতিগতভাবে রুশ। তাদের সঙ্গে রাশিয়ার ঘনিষ্ঠ সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক সম্পর্ক আছে। রাশিয়া কৌশলগতভাবে ইউক্রেনকে তার বাড়ির ‘পিছনের আঙ্গিনা’ বলে বিবেচনা করে। প্রেসিডেন্ট পুতিন মনে করেন, পশ্চিমা শক্তি আসলে ন্যাটো জোটকে ব্যবহার করে চারিদিক থেকে রাশিয়াকে ঘিরে ফেলছে। তিনি চান ন্যাটো যেন পূর্ব ইউরোপে তাদের সামরিক তৎপরতা কমিয়ে আনে।
তিনি বহুদিন ধরে অভিযোগ করে যাচ্ছেন, ১৯৯০ সালে যুক্তরাষ্ট্র ন্যাটো জোটকে পূর্বদিকে সম্প্রসারণ করা হবে না বলে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, সেটি তারা রাখেনি। তবে ন্যাটো রাশিয়ার এই কথা প্রত্যাখ্যান করেছে। তারা বলছে, ন্যাটো জোটের মাত্র অল্প ক’টি দেশের সঙ্গে রাশিয়ার সীমান্ত রয়েছে, আর ন্যাটো হচ্ছে একটি আত্মরক্ষামূলক সামরিক জোট। অনেকের বিশ্বাস, ইউক্রেনকে ঘিরে রাশিয়ার যে বিরাট সৈন্য সমাবেশ, তার উদ্দেশ্য আসলে রাশিয়ার নিরাপত্তা সম্পর্কিত বিষয়গুলো যাতে পশ্চিমারা গুরুত্বের সঙ্গে নেয়, সেজন্য বাধ্য করা।
তবে ইউক্রেনকে ন্যাটো সামরিক জোটে ঢুকতে না দেওয়ার যে দাবি রাশিয়া জানাচ্ছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তা নাকচ করে দিয়েছে। রাশিয়া যখন ইউক্রেনে হামলা চালাতে পারে বলে আশংকা করা হচ্ছে, তখন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন রাশিয়ার কাছে পাঠানো এক আনুষ্ঠানিক জবাবে এ কথা জানিয়েছেন।
ন্যাটোর সেক্রেটারি জেনারেল জেন্স স্টোলটেনবার্গ বলেছেন, তাদের সামরিক জোটের জবাবও মস্কোর কাছে পাঠানো হয়েছে। তিনি বলেন, রাশিয়ার উদ্বেগের বিষয়গুলো তিনি শুনতে রাজি আছেন, কিন্তু এটাও বুঝতে হবে প্রত্যেকটি দেশের তার মতো করে নিজের প্রতিরক্ষার পথ বেছে নেওয়ার অধিকার আছে।