ব্রিটিশদের পক্ষ নিয়ে স্বাধীনতা আন্দোলনের বিরোধিতা করে গিয়েছিল রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ। সেই আরএসএস-এর আত্মজা ‘বিজেপি’। বর্তমানে দেশের শাসক দলের হাতে নেই কোনও স্বাধীনতা সংগ্রামী। স্বাধীনতা যোদ্ধা যদি না থাকে, তাহলে দেশ প্রেমের জিগির তুলবে কি করে? তাইতো বল্লভ ভাই প্যাটেলের পর এবার নেতাজি সুভাষচন্দ্রকে ছিনতাই করতে চাইছে বিজেপি। সমাজতন্ত্র ও সম্প্রীতির অনুসারী নেতাজি নাকি হিন্দুত্বের ভাবাদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন! বিষয়টি নিয়ে আলোকপাত করেছেন কলামিস্ট ড. রাম পুনিয়ানি।
এই বছর নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর জন্মদিবস (২৩ জানুয়ারি) উপলক্ষে একাধিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। রাষ্ট্রপতি ভবনে তাঁর প্রতিকৃতি উন্মোচন করেন রাষ্ট্রপতি। মোদি সরকারের তরফে ঘোষণা করা হয় অতঃপর নেতাজির জন্মদিবসকে ‘পরাক্রম দিবস’ হিসেবে পালন করা হবে। রেলমন্ত্রী হাওড়া-কালনা মেলের নাম পরিবর্তন করে ‘নেতাজি এক্সপ্রেস’ রাখেন। অপরদিকে– মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করেন– নেতাজির জন্মদিনটিকে পালন করা হবে ‘দেশনায়ক দিবস’ হিসেবে। আবার বিজেপির সোশ্যাল মিডিয়া গ্রুপে মিথ্যা প্রচার চালানো হয়– কংগ্রেস যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে নেতাজির জন্মদিন পালন করেনি। এই প্রচারও চালানো হয়– নেতাজি ‘হিন্দুত্ব’কে নাকি সমর্থন করতেন। ভারতের স্বাধীনতা ইতিহাসের নায়কদের এভাবেই বিজেপি আত্মসাৎ করার চেষ্টা করছে। সেই তালিকায় নেতাজি হলেন নতুন সংযোজন। নিঃসন্দেহে নেতাজি হলেন— এক মহান ব্যক্তিত্ব। বিজেপি এর আগে নেতাজিকে নিয়ে এত মাতামাতি কখনও করেনি– যেভাবে এখন তাদের করতে দেখা যাচ্ছে। বিজেপি নেতাজির প্রকৃত নীতি এবং আদর্শকে ধামাচাপা দিয়ে প্রচার করতে চাইছে— তিনি আসলে সংঘের সাম্প্রদায়িক নীতি এবং আদর্শের অনুসারী ছিলেন। কিন্তু ঐতিহাসিক সত্য হল— নেতাজি গণতন্ত্র– সমাজবাদ এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন।
কিন্তু মোদি সরকার হিন্দুরাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে বিভাজনমূলক রাজনীতি করছে এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে ধূলিসাৎ করছে। কংগ্রেসের সঙ্গে নেতাজির মতপার্থক্য ছিল। স্বাধীনতা অর্জনের পথও নেতাজি এবং কংগ্রেসের ভিন্ন ছিল। কিন্তু লক্ষ্য ছিল অভিন্ন। ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের দু’বার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন নেতাজি। নেতাজি এবং কংগ্রেসের মতপার্থক্য সামনে আসে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যখন মহাত্মা গান্ধির নেতৃত্বে কংগ্রেস ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের ডাক দেয়। নেতাজি এই সময় ব্রিটিশ শক্তি বিরোধী জার্মানি এবং জাপানের সঙ্গে জোট করে ভারত থেকে ব্রিটিশদের তাড়াতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কংগ্রেসের সেন্ট্রাল কমিটির বেশিরভাগ সদস্য ছিলেন গান্ধির সঙ্গে। কংগ্রেসের প্রথম সারির নেতা প্যাটেল এবং নেহরু ছিলেন নেতাজির প্রস্তাবের বিরোধী। এই মতভেদ ছিল মূলত কৌশলগত কারণে। কিন্তু অপরদিকে– হিন্দু মহাসভা এবং আরসস বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটেনকে সমর্থন করেছিল। হিন্দু মহাসভার নেতা সাভারকার ব্রিটিশ সেনাকে শক্তিশালী করার উদ্দেশে ভারতীয়দের ব্রিটিশ সেনায় ভর্তি করানোর জন্য মাঠে নামেন।
অপরদিকে– নেতাজি ব্রিটিশ সেনার মোকাবিলা করার জন্য সিঙ্গাপুরে বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর গঠন করা ‘আজাদ হিন্দ ফৌজ’ যোগ দেন। নেতাজি সারাজীবন কংগ্রেসের প্রশংসা করে গিয়েছেন। গান্ধি এবং নেহরুরও তিনি আজীবন প্রশংসক ছিলেন। তিনি মহাত্মা গান্ধিকে এই সময় যে চিঠি লিখেছিলেন– তাতে গান্ধিকে তিনি ‘রাষ্ট্রপিতা’ হিসেবে সম্বোধন করেন। আজাদ হিন্দ ফৌজ-র দুটি ব্রিগেডের নামকরণ করেন নেতাজি— নেহরু এবং গান্ধির নামে। তাঁর আজাদ হিন্দ বাহিনীর জন্য তিনি আশীর্বাদও চেয়েছিলেন গান্ধির কাছে। অপরদিকে– হিন্দু মহাসভা এবং আরসস সমাজবাদ এবং রাষ্ট্রের কল্যাণমূলক প্রকল্পগুলির বিরোধিতা শুরু করে। নেতাজি ছিলেন কিন্তু ঘোর সমাজবাদী। তিনি কংগ্রেসে থাকাকালীন নেহরুর সঙ্গে মিলে স্বাধীনতা সংগ্রামকে এক সমাজবাদী দিশায় চালিত করেছিলেন। যখন তিনি কংগ্রেস ছেড়ে ফরওয়ার্ড ব্লক গঠন করেন– সেই সংগঠনকেও তিনি সমাজবাদের আদর্শে প্রতিষ্ঠিত করেন। বহু দশক পরে ফরওয়ার্ড ব্লক পশ্চিমবঙ্গের বামশাসক জোটের শরিক হয়েছিল। কংগ্রেসও আজাদ হিন্দ ফৌজকে সম্মান করত। যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়– তখন আজাদ হিন্দ ফৌজের বিচার হয়েছিল আদালতে। সেই সময় এই অফিসারদের পক্ষে মামলা লড়েছিলেন ভুলাভাই দেশাই এবং জওহরলাল নেহরুর মতো কংগ্রেসি আইনজীবীরা।
মনে রাখতে হবে, বাংলায় মুসলিম লিগের নেতৃত্বে যে সরকার গঠিত হয়েছিল তাতে শামিল ছিলেন হিন্দু মহাসভার নেতা শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি। যখন ব্রিটিশ সরকার গান্ধিজির ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনকে দমন করা শুরু করল– তখন ব্রিটিশ সরকারকে আশ্বস্ত করে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি বলেছিলেন– বাংলায় এই আন্দোলনের প্রভাব নিয়ে চিন্তা করবেন না। হিন্দু মহাসভা এই আন্দোলনের বিরোধিতা করবে। তেমনি সাভারকর বলেছিলেন– তিনি ব্রিটিশ সেনাকে শক্তিশালী দেখতে চান। অন্যদিকে– আরএসএস নেতা গোলওয়ালকর একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করে ব্রিটিশদের আশ্বস্ত করেছিলেন যে– আরএসএস এমন কোনও কাজ করবে না যা ব্রিটিশদের বিরক্তির কারণ হয়।
আরএসএস এবং হিন্দু মহাসভার মূলমন্ত্র ছিল ভারতকে ‘হিন্দুরাষ্ট্র’ হিসেবে গড়ে তোলা। তারা কোনওদিন নেতাজির জাতীয়তাবাদ এবং হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের আদর্শকে পছন্দ করেনি। নেতাজি লিখেছেন– ‘মুসলমানদের আগমনের পর দেশে এক সমন্বয় গড়ে উঠেছে। তারা হিন্দুদের ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়নি বটে– কিন্তু তারা ভারতকে নিজেদের দেশ বলে স্বীকৃতি দেয় এবং এই দেশের মানুষের সঙ্গে তারা তাদের সুখ-দুঃখ ভাগ করে নেয়। সামাজিক জীবনেও মুসলমানরা মিশে যায়। পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে এক যৌথ শিল্প এবং নতুন সংস্কৃতি গড়ে ওঠে।’ তিনি আরও লেখেনঃ ‘ভারতীয় মুসলিমরা স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দেয়।’ সংখ্যালঘুদের অধিকার সুনিশ্চিত করতে তিনি এমন একটি রাষ্ট্রের কল্পনা করেছিলেন– যেখানে ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা উপভোগ করবেন প্রত্যেক ব্যক্তি এবং গোষ্ঠী। সেই রাষ্টেÉর নিজস্ব কোনও ধর্ম থাকবে না।’ (ফ্রি ইন্ডিয়া অ্যান্ড হার প্রবলেমস)।
আরএসএস-এর নেতারা মনে করেন– ভারতে আদি এবং মূল বাসিন্দা ছিল আর্যরা। ভারত থেকে তারা পাড়ি দিয়েছিল ইউরোপ এবং পশ্চিম এশিয়ায়। কিন্তু নেতাজি বলেছিলেনঃ প্রত্নতাত্ত্বিক খননে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ হয়েছে যে ভারতে আর্যদের আগে খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ সালে ভারতে এক উন্নত সভ্যতার অস্তিত্ব ছিল।’ নেতাজি মহেঞ্জোদারো এবং হরপ্পার সভ্যতাকে ভারতের আদি সভ্যতা হিসেবে মানতেন বৈজ্ঞানিক প্রমাণের ভিত্তিতে। ভারতীয় সভ্যতায় হিন্দু আর্যদের মূল নিবাসী হিসেবে মানতে অস্বীকার করেছিলেন নেতাজি। প্রায়শই হিন্দুত্ব জাতীয়তাবাদীরা ভারতের জাতীয় আইকনদের নিজেদের আদর্শে বিশ্বাসী বলে প্রচার করে থাকেন। যেমন স্বামী বিবেকানন্দ– সরদার প্যাটেল এবং অবশ্যই নেতাজি। হিন্দুত্ববাদীদের মতে– এরা সবাই নাকি হিন্দুত্ব ধ্বজাধারী যুগপুরুষ– যাঁরা হিন্দু জাতীয়তাবাদী মতবাদে বিশ্বাসী এবং তার প্রচারক। অথচ এই যুগপুরুষদের জীবনী ও লেখা পড়লে বোঝা যায়— এরা ছিলেন হিন্দু-মুসলিম সমন্বয়ে বিশ্বাসী। তেমনি নেতাজি ছিলেন হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের প্রতীক যিনি গান্ধিকে ‘রাষ্ট্রপিতা’ বলে অভিহিত করেছিলেন। অথচ গান্ধিকে হত্যা করে একজন হিন্দু জাতীয়তাবাদী।