সম্প্রতি ধর্মীয় সংগঠন ব্রহ্ম কুমারীদের এক সভায় ভাষণ প্রদান করিবার সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলিয়াছেন, ভারতের যে আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি রহিয়াছে তাহাকে বদনাম করিবার প্রচেষ্টা চলিতেছে।
তিনি স্পষ্ট করিয়া বলিয়াছেন, এই বিষয়টিকে শুধুমাত্র ‘রাজনীতির বিষয়’ আখ্যা দিয়া কার্পেটের নিচে ঢাকিয়া রাখা সম্ভব নহে। কারণ, ইহার সহিত দেশের সুনাম জড়িত রহিয়াছে। তিনি এই ধরনের ভুল তথ্যকে প্রতিহত করিবার জন্য ব্রহ্ম কুমারী ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংগঠনের নিকট আহ্বান জানান। মোদিজি বলেন, আপনাদের পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের জনগণের নিকট সঠিক তথ্য তুলিয়া ধরার কাজটি সুনিশ্চিত করিতে হইবে। ভারত সম্পর্কে যে গুজব ছড়ানো হইতেছে, তাহার বিরুদ্ধে লড়াই করা সকলের কর্তব্য।
কি ধরনের গুজব কিংবা কোনও ঘটনার কথা কিন্তু মোদিজি তাঁহার ভাষণে উল্লেখ করেন নাই। তবে মোদিজি কিন্তু একটি সত্য কথা উচ্চারণ করিয়াছেন। বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ– সংবিধানে জাতি– ধর্ম– বর্ণ– লিঙ্গ নির্বিশেষে প্রত্যেক নাগরিককে সমানাধিকার প্রদান এবং নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থার অধিকারী হিসাবে সারা বিশ্বে ভারতের প্রবল সুনাম ছিল। মোদিজি সঠিকভাবে বলিয়াছেন, এই সুনামে সাম্প্রতিক বৎসরগুলিতে চিড় ধরিয়াছে। বিরোধীদের অভিযোগ– সংবিধান লঙ্ঘন বর্তমানে শাসক দলের কাছে– কেন্দ্র ও তাহাদের শাসিত রাজ্যগুলিতে প্রায় নিয়মে পরিণত হইয়াছে। গণতন্ত্র ও মানবাধিকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রশ্নের মুখে পড়িয়াছে। দেশে নিম্নবর্ণ– দলিতদের উচ্চবর্ণের দ্বারা ধর্ষণ– হত্যা ও অপমান-নির্যাতন এখন প্রায় নিত্যদিনের ঘটনা। ইহা ব্যতীত সংখ্যালঘু মুসলিম– খ্রীষ্টান– শিখদের লিঞ্চিং– তাহাদের উপাসনালয়ে হামলা– ইতিহাস বিকৃতি এবং সাম্প্রদায়িক হত্যালীলা দেশের ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বল করে নাই। তাহার উপর বিজেপি ও আরএসএস ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের দ্বারা গঠিত ধর্ম-সংসদ হইতে মুসলিমদের গণহত্যার আহ্বান প্রভৃতি দুনিয়ায় ভারতের সুনামের উপর প্রশ্ন চিহ্ন আঁকিয়া দিয়াছে। বিশেষ করিয়া রাষ্ট্রপুঞ্জ হইতে শুরু করিয়া বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ভারতে সংঘটিত এইসব ঘটনায় নিরন্তর উদ্বেগ প্রকাশ করিতেছে। আরব দেশগুলিতে প্রায় ৩৪-৩৫ লক্ষ ভারতীয় ব্যবসা ও কাজ করিয়া থাকেন। তাহারা মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা ভারতে প্রেরণ করেন। সেই আরব দেশগুলিতে ভারতীয় সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন একটি বৃহৎ ইস্যু হইয়া দাঁড়াইয়াছে। সেখানকার রাজা– বাদশাহ– শেখরা নিজ স্বার্থে নিরব থাকিলেও সাধারণ মানুষ– ছাত্র সমাজ ও নেটিজেনরা ভারতে হিংসা ও ঘৃণার প্রসার লইয়া সরব হইয়াছেন।
মোদিজিকে ভাবিতে হইবে– বর্তমানে যেভাবে ডিজিটাল দুনিয়া প্রসারিত হইতেছে– সোশ্যাল মিডিয়া সারা বিশ্বে জনমত গঠনে বড় ভূমিকা পালন করিতেছে– তাহাতে কোনও খবর গোপন করা খুবই কষ্ট সাধ্য। কিছু কিছু রাষ্ট্র অবশ্য নেটিজেন– পোর্টাল ও ইউটিউবের উপর পুলিশের ভীতি প্রদর্শন– গ্রেফতার এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা বিরোধী আইন ব্যবহার করিয়া বিরোধীদের মুখ বন্ধ করিবার প্রচেষ্টা করিতেছে। কিন্তু তাহা সত্ত্বেও বিলম্ব হইলেও বর্তমান দুনিয়ায় খবর গোপন করা খুবই কঠিন। দিন কয়েক পূর্বে মোদি সরকার অবশ্য ৩৫টি ইউটিউব চ্যানেলকে ‘দেশ বিরোধী’ আখ্যা দিয়া নিষিদ্ধ করিয়াছে। তাই প্রয়োজন এমন সব ঘটনা– ভাষণ– হেট ক্যাম্পেন– ফেক নিউজ ও ভিডিয়ো ইত্যাদির দিকে নজর রাখিয়া এবং আইন অনুসারে ব্যবস্থা লওয়া।
হাথরসের ঘটনা– দিল্লি দাঙ্গা– পূর্বে গুজরাত হত্যাযজ্ঞ এবং হরিদ্বার ধর্ম-সংসদ হইতে ও বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন স্থান হইতে আরও অনেক ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব ও সংগঠন যেইভাবে মুসলিমদের গণহত্যার খুল্লমখুল্লা আহ্বান জানাইতেছে– তাহা অবশ্যই ভারতের সঠিক ভাবমূর্তির পক্ষে আঘাত স্বরূপ। মহিলাদের প্রতিও সোশ্যাল মিডিয়া ও নানা মঞ্চ হইতে যে ধরনের অপমান ও ভাবনা ব্যক্ত হইতেছে– তাহা সতী সাবিত্রির এই দেশে অবশ্যই লজ্জাজনক। এই ধরনের বহু অবৈধ ও প্ররোচক ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী মোদিজির বিসদৃশ– নীরবতা ভারতের ইমেজকে সারা বিশ্বে নষ্ট করিয়াছে।
ভারতের বদনাম হইতেছে– ইহা প্রতিরোধ করা অবশ্যই দেশের প্রত্যেক নাগরিকের কর্তব্য। কিন্তু মোদিজি– তাহার জন্য প্রয়োজন হইল লজ্জাজনক নানা ঘটনাকে আড়াল করিবার চেষ্টা না করিয়া দেশ যাহাতে এই ধরনের ঘটনা ও আবহ হইতে মুক্ত থাকে সেই উদ্দেশে ব্যবস্থা লওয়া।
এই কলঙ্কজনক আচরণ বন্ধ করিতে এবং অপচেষ্টাগুলিকে অঙ্কুরেই বিনাশ করিতে ব্যবস্থা গ্রহণ না করিলে ভারত প্রেমিকগণ সংকটে পড়িবেন এবং ভারত বিরোধীরা ইহার সুযোগ গ্রহণ করিবেন। নিরপেক্ষ ব্যক্তিরাও হতাশ বোধ করিবেন। আমাদের সকলের প্রত্যাশা বুদ্ধ– গান্ধি– মাওলানা আজাদ এবং বাবা আম্বেদকরের ভারত বিশ্বের আদর্শ হইবে। কিন্তু তাহার জন্য আইন ও সংবিধানের উপর আস্থা রাখিয়া সকল নাগরিকের জন্য মোদিজিকে এক ভয়মুক্ত ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি করার পদক্ষেপ লইতে হইবে। ইহাই হইল ভারতের সুনাম ও মর্যাদাকে সারা বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত করিবার সর্বশ্রেষ্ঠ উপায়।