প্রদীপ মজুমদারঃ পাঁচিল ঘেরা ছোট একটি চকচকে মসজিদ। একতলা মসজিদের মাথায় দুটি গম্বুজ আর ছটি বাহারি মিনার। মসজিদটিতে মাইক নেই– আযানেরও প্রয়োজন নেই। কারণ ওয়াক্তি নামায পড়ার মতো কেউ নেই। কেবলমাত্র প্রতি জুম্মাবার খালি গলায় আযান হয়। সাকুল্যে ৮ থেকে দশজন জুম্মার নামায আদায় করেন। মসজিদের গেটের সামনে লেখা ‘মাসুন্দা জামে মসজিদ’ ‘স্থাপিত ১৮৩৯ সাল’। তার মানে ১৮২ বছর আগের মসজিদ। এখন মাত্র চারঘর মুসলিম আগলে রেখেছেন দুশো বছরের দোরগোড়ায় পৌঁছনো মসজিদটিকে। ওই চারঘর মুসলিম ছাড়া তিন-চার কিলোমিটারে মধ্যে আর কোনও মুসলিম জনবসতি নেই। বাকি সব হিন্দু।
প্রাচীন ২৪টি পরগনার মধ্যে অন্যতম পরগনা মুড়াগাছা। সেই মুড়াগাছা পরগনার প্রাচীন মুসলিম অধ্যুষিত জনপদ ছিল মাসুন্দা এবং আহারামপুর। যদিও এই দুই নামে এখন আর কোনও জায়গা নেই। দেশভাগের পর যখন হিন্দু শরণার্থী স্রোত এই বাংলায় আছড়ে পড়ে– তখন নয়া উদ্বাস্তু কলোনি স্থাপনের জন্য মুছে যায় মাসুন্দা ও আহারামপুর জায়গা দুটির নাম। একে একে কলোনি সম্প্রসারিত হতে থাকায় ওই দুই অঞ্চলে বসবাসকারী মুসলিমরা নিরাপত্তার কারণে চলে যায় ওপার বাংলায়।
তাদেরই ফেলে যাওয়া বিস্তীর্ণ জমিতে খুলনার ইউনিয়ন বোর্ডের দাপুটে সদস্য প্রখ্যাত হরিপদ বিশ্বাস গড়ে তোলেন উদ্বাস্তু কলোনি ‘নিউ বারাকপুর’। কিন্তু এক সময়ের মাসুন্দা অঞ্চলের জমিদার শেখ সৈয়দ উদ্দিন সিদ্দিকীর কয়েকজন বংশধর সাহসের সঙ্গে– আবেগের সঙ্গে আঁকড়ে পড়েছিলেন পূর্বপুরুষের ভিটেমাটি। একা মসজিদটি আর পূর্বপুরুষদের কবরস্থান ফেলে কী করে পালিয়ে যাবে? তাঁদেরই বংশ লতিকা এখন চার থেকে পাঁচটি বাড়িতে এসে ঠেকেছে। এঁদেরই নিয়ন্ত্রণে দুই দিকে দুটি আড়াই-তিন কাঠার পারিবারিক কবরস্থানও রয়েছে। চারদিক ঘিরে রয়েছে হিন্দু বসতি– সকলেই ওপার বাংলা থেকে ছিন্নমূল হয়ে আসা মানুষ। দেশভাগের পর উদ্বাস্তু স্রোতে একে একে দখল হয়ে গিয়েছে এপার বাংলার মুসলিমদের ভিটে-মাটি– ঘর-বাড়ি– এমনকি মসজিদ-ঈদগাহ-দরগাহও। কিন্তু এখানে মসজিদ-কবরস্থান আগের মতোই সুরক্ষিত রয়েছে। প্রতিবেশী হিন্দুরাই সেসব সংরক্ষণে এগিয়ে এসেছেন। আর সেই কারণে বিগত ৭৪ বছর ধরে সম্প্রীতির মেলবন্ধন ছিন্ন হয়নি।
মাসুন্দা জামে মসজিদটি এখন নিউ বারাকপুর পুরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের অন্তর্গত। বলা যায়– এই পুরসভার ২০টি ওয়ার্ডের প্রায় দুই লক্ষ বাসিন্দার মধ্যে এই চারটিই মাত্র মুসলিম পরিবার। মসজিদের সামনে রাস্তা আর তার বিপরীতে অ্যাডভোকেট রেশমি আহমেদদের দোতলা বাড়ি। এক পাশে শাহিদ আহমেদদের ইমারত সামগ্রীর ব্যবসার জায়গা। অন্য পাশে শেখ খলিল আহমেদের বাড়ি। এই তিনটি প্লটের পিছনের দিকে আরও দুটি বাড়ি। এইটুকুই এখন দ্বীপের মতো মুসলিম ‘পাড়া’। মসজিদের পাশে এবং পিছনে কিংবা পারিবারিক কবরস্থানের তিনদিকেও হিন্দু বসতি। যদিও আজ অবধি ধর্মাচারণ নিয়ে প্রতিবেশীদের মধ্যে কোনও বিরোধ দেূা দেয়নি। বরং সব ক্ষেত্রে মিলেছে অকুণ্ঠ সহায়তা।
বছর আটান্নর শেখ খলিল আহমেদের কাছ থেকে জানা যায়– তাঁদেরই আত্মীয় শেখ দ্বীন আহমেদ এই মসজিদে শেষবারের মতো পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়তেন। ভোর পাঁচটায় মসজিদে গিয়ে ঝাড়পোছ করে ফযরের নামায থেকে এশার নামায পর্যন্ত পড়তেন। ১৬ বছর আগে তিনি ইন্তেকাল করার পর এখন আর মসজিদটিতে কেউ ওয়াক্তি নামায পড়েন না। তবে ওই চারঘর মানুষ চাঁদা দিয়ে শেখ ইসরাইল নামে একজন মৌলানাকে ইমামতির দায়িত্ব দিয়েছেন। চার কিলোমিটার দূরের পানিহারা থেকে সেই ইমাম সাহেবই ৪-৫ জনকে সঙ্গে নিয়ে আসেন প্রতি জুম্মাবারে। তাঁরা সেখানে নিয়মিত জুম্মার নামায আদায় করেন। তাতে অংশ নেন স্থানীয়রাও।
খলিল সাহেবের পরিবারের কাছ থেকে আরও জানা যায়– প্রতি বছর রোজার সময় ইমাম সাহেবের সঙ্গে বাইরে থেকে ৩৫-৪০ জন মুসল্লি আসেন এই মসজিদে। ওয়াক্তি নামায ছাড়াও তখন তারাবীহ’র নামাযও অনুষ্ঠিত হয়। আর ওই চার ঘর মুসলিম পরিবার থেকে পালা করে ইফতারের ব্যবস্থা করা হয়। এ ছাড়া দুই ঈদের নামাযে সকলে অংশ নেন।
এলাকায় প্রাচীনতম স্থাপত্য হিসাবে ১৮২ বছরের পুরনো মসজিদটি এক সময় জরাজীর্ণ হয়ে গিয়েছিল। স্থানীয় সানি আহমেদের তৎপরতায় বিভিন্ন জায়গা থেকে চাঁদা তুলে মসজিদটি সংস্কার করা হয়। এই পরিবারগুলির কেউ ইন্তেকাল করলে প্রতিবেশীদের সম্মতি নিয়েই তাদের পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। এতে প্রতিবেশী হিন্দুরা কখনও আপত্তি জানাননি। এলাকার মানুষ জানেন– মসজিদের আশপাশের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে এক সময় সবাই পানীয় জল সংগ্রহ করতে আসত মসজিদ চত্বরে। কারণ প্রাচীন এবং একমাত্র চাপাকল ছিল মসজিদের জমিতেই। কলতলাটি এখনও আছে– তবে জলটাই যা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এখন সেখানে পুরসভার সাপ্লাই করা জল।