পুবের কলম, ওয়েবডেস্কঃ তিন কৃষি আইন প্রত্যাহার করার কথা ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ১৯ নভেম্বর– শুক্রবার। গত বছরের ২৬ নভেম্বর থেকে দিল্লি সীমান্তে মূলত পাঞ্জাব ও হরিয়ানার কৃষকরা বিরোধিতা করেছেন এই আইনের।
তাহলে এই আইন কতদিন কার্যকরী ছিল? তিন কৃষি আইনের (দ্য ফার্মার্স প্রোডিউস ট্রেড অ্যান্ড কমার্স (প্রমোশন অ্যান্ড ফেসিলিটেশন) আইন– ২০২০— দ্য ফার্মার্স (এমপাওয়ারমেন্ট অ্যান্ড প্রটেকশন) এগ্রিমেন্ট অন প্রাইস অ্যাসিওরেন্স অ্যান্ড ফার্ম সার্ভিসেস আইন– ২০২০— দ্য এসেন্সিয়াল কমোডিটিস (সংশোধিত) আইন– ২০২০) যাত্রা শুরু হয়েছিল ২০২০ সালের ৫ জুন। তিন অধ্যাদেশে সবুজ সংকেত দেন ভারতের রাষ্ট্রপতি এবং সেটাই এই আইনের শুরুয়াত। এই তিন অধ্যাদেশকে সরানো হয়েছিল আগে উল্লিখিত আইন দিয়ে যা গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে সংসদে পাশ হয়েছিল। তবে ২০২১ সালের ১২ জানুয়ারি এই আইন কার্যকরীর উপর স্থগিতাদেশ দেয় সুপ্রিম কোর্ট। ফলত– এই আইন মাত্র ২২১ দিন বলবৎ ছিল।
কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর আইন প্রত্যাহার ঘোষণার পর পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে?
কোনও আইন লাগু করা– সংশোধন করা ও প্রত্যাহার করার ক্ষমতা রয়েছে সংসদের। আগামী অধিবেশনে এই তিন আইন প্রত্যাহার করতে সরকারকে বিষয়টি তুলতে হবে। যে মন্ত্রিরা এই আইন তৈরি করতে বিল পেশ করেছিলেন তাঁরাই সংসদে বিষয়টি উত্থাপন করবেন। কিন্তু প্রশ্ন হল– এতদিন জোরালোভাবে এই আইনের পক্ষে সওয়াল করার পর সরকার কেন পিছু হটল? সরকারের পক্ষ থেকে এর কোনও কারণ জানানো হয়নি। সংসদের শীতকালীন অধিবেশনের ঠিক আগেই এই সিদ্ধান্ত এল। সংসদের গত অধিবেশনে এই আইন নিয়ে বিরোধীরা সরকারকে তীব্রভাবে আক্রমণ করেছিল এবং তার ফলে সংসদের ক্রিয়াকলাপে বিঘ্ন দেখা দেয়। পাশাপাশি উত্তরপ্রদেশ– পাঞ্জাব– উত্তরাখণ্ড– হিমাচল প্রদেশ ও গোয়ায় বিধানসভা নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী এই ঘোষণা করেছেন। পাঞ্জাবে পঞ্চায়েত ভোট ও হরিয়ানায় উপনির্বাচনে বিজেপির ফল আশানুরূপ হয়নি।
যদিও কৃষিতে ঐতিহাসিক সংস্কারের অংশ হিসাবে এই তিনটি কৃষি আইন পাশ করা হয়েছে বলে দাবি করা হয়েছিল। তাহলে এই প্রত্যাহারের প্রভাব কতটা পড়তে পারে সংস্কার কাজে? এই আইনকে জোর গলায় তীক্ষ্ণ ও উচ্চস্বরে ‘ঐতিহাসিক’ বলে প্রচার করা হয়েছিল– কিন্তু তা শেষ পর্যন্ত ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হল বিজেপি সরকার। এরপর কোনও রকম সংস্কারের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সরকারকে সতর্কতার পথ অবলম্বন করতে হবে। মোদিভক্তদের কাছে মোদি হলেন শক্তি– সাহস– দৃঢ়তার প্রতীক। এইভাবে তা কি আগে কখনও ধাক্কা খেয়েছে?
একটা উদাহরণ রয়েছে যেবার মোদি সরকার প্রথম দফার শাসনামলে এইভাবে পিছু হটেছিল। রাইট টু ফেয়ার কমপেনসেশন অ্যান্ড ট্রান্সপারেন্সি ইন ল্যান্ড অ্যাকুইজিশন– রিহ্যাবিলিটেশন অ্যান্ড রিসেটেলমেন্ট আইন (আরএফসিটিএলএআরআর)– ২০১৩ সংশোধন করার জন্য একটি অধ্যাদেশ প্রত্যাহার করেছিল মোদি সরকার। বিরোধিরা সংসদের ভিতরে ও বাইরে লাগাতার প্রতিবাদ-বিক্ষোভ জারি রেখেছিল। সে ক্ষেত্রে সরকারের রাজনৈতিক বিবেচনা কী ছিল? ২০১৫ সালের ২০ এপ্রিলে লোকসভায় কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধি সরকারকে আক্রমণ করেন। রাহুল বলেন– ‘আপনাদের সরকার কৃষকদের সমস্যাকে উপেক্ষা করছে এবং শ্রমজীবীদের স্বর শুনতে চাইছে না। আপনাদের সরকার শিল্পপতিদের সরকার– বড় লোকেদের সরকার– সুট-বুটপরা লোকেদের সরকার। আমরা সকলে সেটা বুঝি। একদিকে আমরা কৃষক ও শ্রমজীবীদের দুর্বল করে তুলছি এবং যখন তাঁরা নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছেন তখন আপনাদের অধ্যাদেশ দিয়ে তাঁদের আঘাত করছেন আপনারা।’
যাইহোক– বাজেট অধিবেশনের দ্বিতীয় পর্বে সেই বিল পর্যালোচনার জন্য পাঠানো হয় যুগ্ম পার্লামেন্টারি কমিটির কাছে। ৩০ মে সরকার পুনরায় অধ্যাদেশ জারি করে আরএফসিটিএলএআরআর (সংশোধিত) দ্বিতীয় অধ্যাদেশ– ২০১৫ হিসাবে। সেবার সরকার কীভাবে পিছু হটলো? সংশোধন নিয়ে লাগাতার বিরোধিতার মধ্যে ২০১৫ সালের ৩১ আগস্ট সম্প্রচারিত ‘মন কি বাত’ অনুষ্ঠানে ওই অধ্যাদেশ প্রত্যাহার করার কথা ঘোষণা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
তিনি তখন বলেছিলেন– ‘আমি সব সময়ই বলেছি যে– জমি অধিগ্রহণ আইন নিয়ে মতামত ও পরামর্শ শোনার জন্য সরকার প্রস্তুত। আমি বারবার বলেছি যে– কৃষকদের স্বার্থে যে কোনও রকম পরামর্শ শুনতে আমি রাজি। কিন্তু আজ– আমি আমার কৃষক ভাইবোনদের বলতে চাই যে– রাজ্যগুলি জোর দিয়ে জমি অধিগ্রহণ আইন সংস্কারের অনুরোধ করেছিল আর তাই সংস্কারের প্রস্তাব উঠেছিল।’’ এরপর মোদি বলেন– ‘‘কিন্তু আমি দেখলাম কীভাবে কৃষকদের ভুল পথে পরিচালিত করা হল এবং তাদের মধ্যে ভয় তৈরি করা হয়েছে। ‘ঘটনাক্রমে সেই বিল প্রত্যাহৃত হয়’।
আর তিনটি কৃষি বিল প্রত্যাহারের ঘোষণার সময় প্রধানমন্ত্রী একই ভঙ্গীতে ক্ষমা প্রার্থনা করে বললেন– এই তিনটি আইনের ভালো দিকগুলি আমরা কৃষকদের বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছি। আগের জমি বিলের মতো তিনটি বিতর্কিত কৃষি আইন ভালোয় ভালোয় প্রত্যাহৃত হোক— এটাই এখন মঙ্গল দেশের কাছে– দলের কাছেও।