পুবের কলম, ওয়েবডেস্ক: : ঐতিহ্য না অভিশাপ! দেশের একটি রাজ্যে এখনও দ্রৌপদী প্রথার চল রয়েছে। হিমাচলের ট্রান্সগিরিতে হাট্টি হল সেই সম্প্রদায়। এই উপজাতির মধ্যে এক স্ত্রীর বহু স্বামীর প্রথা বর্তমান। একজন কন্যা পরিবারের একজন পুরুষের স্ত্রী হন, পরবর্তী সময়ে তাকে স্বামীর অন্যান্য ভাইদেরও বিয়ে করতে হয়। তাদের সন্তানের মা হতে হয়। হিমাচল প্রদেশের হাট্টি সম্প্রদায়ের জীবন এই ‘জোড়িদারান’, পলিয়ান্ড্রি প্রথার অংশ। এটি শুধু প্রথার গল্প নয়, এটি অসহায়তার গল্পও। স্বচ্ছ আকাশ, খাড়া সবুজ পাহাড়, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের মধ্যে কঠিন বাস্তবের কাহিনি। তবে হাট্টি সম্প্রদায়ের প্রবীণদের একাংশ জানিয়েছেন, ধীরে ধীরে এই প্রথা বিলুপ্তির পথে।
২৫ বছর আগে সুনীলাদেবী কনে হয়ে আসেন হিমাচলের সিরামাউরের জামনা গ্রামে। তার দেওর তখন স্কুলে পড়তেন। তিনি তখন তার জন্য রুটি বানাতেন। যখন দেওর বড় হয়ে উঠল, সুনীলাদেবীর স্বামী তাকে দেওরকেও স্বামী হিসেবে মেনে নিতে বললেন। সুনীলাদেবী জানান, এক সন্ধ্যায় ছোট ভাই ও তার পরের দিন বড় ভাইয়ের পালা, এটাই ছিল জীবন।
ট্রান্স-গিরি এলাকার ১৩০০ বর্গকিলোমিটার জুড়ে ১৫৪টি পঞ্চায়েত রয়েছে এবং হাট্টি সম্প্রদায় ১৪৭ টিতে টিকে আছে । পলিয়ান্ড্রি, হাট্টি সম্প্রদায়ের জোড়িদারান প্রথা নামে পরিচিত, হিমালয়ের পাদদেশের কিছু অংশ সহ অন্যান্য সম্প্রদায়ের মধ্যেও এখনও এই প্রথা দেখা যায়। পলিয়ান্ড্রি হিমাচল প্রদেশের কিন্নর জেলা এবং প্রতিবেশী উত্তরাখণ্ডের কিছু এলাকায়ও প্রচলিত।
সুনীলাদেবী জানান, খুব দরিদ্র পরিবারে বিয়ে হয়েছিল, একটি সোয়েটার, এক জোড়া চপ্পল আমাকে আর শাশুড়িমাকে ভাগাভাগি করতে পরতে হত।
হাট্টি সম্প্রদায়ের মধ্যে লিঙ্গ বিভাজন স্পষ্ট। পুত্র সন্তান জন্মালে আমোদ আহ্লাদ, কিন্তু কন্যা সন্তানের জন্য শুধুই নীরবতা। সম্প্রদায়টি মনে করে এই দ্রৌপদী প্রথা তাদের মধ্যে দৃঢ় মনোবল গড়ে তোলে। কারণ দ্রৌপদীই পাণ্ডবদের একত্রিত করেছিল, কৌরবদের পরাজিত করে। সম্প্রদায়গুলি মূলত গৃহস্থালি, কৃষিকাজ করে থাকে।
সুনীলাদেবী জানিয়েছেন, পরিবারের যুক্তি অত্যন্ত গরীব পরিবার, তাই এক স্ত্রীকে সব ভাইদের যৌন ইচ্ছে পূরণ করতে হয়। কারণ প্রত্যেক ভাইয়ের আলাদা স্ত্রী মানেই বাড়তি খরচ। তিনি বড় ভাইকে “বড়ে ঘরওয়ালা (বড় স্বামী)” এবং ছোট ভাইকে “ছোটে ঘরওয়ালা” (ছোট স্বামী) বলে ডাকেন।
সুনীলাদেবী আরও জানান, ভালোবাসার কথা শুনলে হাসি পায়, যখন হিমাচলের পাদদেশ নেমে বৃষ্টি নেমে আসে, তখন আমরা আমরাও প্রাণজুড়িয়ে একটু কাঁদতে পারি।
তবে সুনীলাদেবী জানান, ছোট স্বামী তার বেশি খেয়াল রাখে। অসুস্থ হলে যত্ন নেয়। ছোট স্বামী ঘরে থাকে, আর বড় স্বামী কাজের জন্য বাইরে যায়। তবে আমি দুই ভাইয়ের মধ্যে কোনও পার্থক্য করি না, আমি আমার কর্তব্য পালন করি। দুই পুরুষের শারীরিক ইচ্ছে মেটাতে হয়, তবে সব কিছু মেনে নিয়েছি। সুনীলাদেবীর বাড়ির কিছুটা দূরে তৈরি হয়েছে মীনাদেবীর বাড়ি। মীনা তিনভাইয়ের স্ত্রী। তবে মীনাদেবী আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে জানিয়েছেন, তিনি কখনই চান না তার সন্তানরা পালিয়ান্ড্রি প্রথায় মেনে চলুক। তার দুই ছেলে চাকরি পেয়েছে এবং আলাদা মহিলাদের সঙ্গে বিবাহিত। আমরা নিশ্চিত করেছি যে আমাদের মেয়েদেরও জোড়িদারান প্রথায় প্রবেশ করতে হবে না।
পাশাপাশি মুকেশ বলে অপর এক গ্রামবাসী জানিয়েছেন, তিনি পরিবারের পঞ্চম প্রজন্ম। মুকেশ ও তার ভাই একই মহিলার সঙ্গে বিবাহিত। তবে তার কন্যা এমএ-বিএড। তাই সে নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নিজেই নেবেন।
কেন্দ্রীয় হাট্টি কমিটির সাধারণ সম্পাদক কুন্দন সিং শাস্ত্রী, পাণ্ডবদের সঙ্গে পলিয়ান্ড্রি প্রথার যুক্ত করে বলেন, তারা মনে করে মহাভারতের পাণ্ডবরা কিছু সময় এই অঞ্চলে ছিলেন। হাট্টি সম্প্রদায়ের প্রথা এবং ঐতিহ্যগুলি উত্তরাখণ্ডের জন্সার-বাওয়ার অঞ্চলের সম্প্রদায়গুলির মতো। তারা অনেক আগেই উপজাতি মর্যাদা পেয়েছে, কিন্তু আমাদের সম্প্রতি দেওয়া হয়েছে। পলিয়ান্ড্রি প্রথা সিরমৌর জেলার প্রায় ৩৫০টি গ্রামের মধ্যে পাওয়া যায় যেখানে হাট্টি সম্প্রদায় বসবাস করে। শাস্ত্রীর বিশ্বাস, আরও বেশি গ্রামবাসী শিক্ষিত হয়ে উঠছে, চাকরির জন্য বাইরে চলে যাচ্ছে, হাট্টি সম্প্রদায়ের মধ্যে জোড়িদারান প্রথা ধীরে ধীরে শেষ হবে।