বিশেষ প্রতিবেদক: এবারে নিট ইউজি ২০২৪ পরীক্ষায় ১ নম্বর র্যাঙ্ক করেছেন মুম্বইয়ের আমিনা আরিফ কাদিওয়ালা। তাঁর তারিফ করার জন্য বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বৃত্তান্তের উদাহরণ দেওয়া যায়। প্রথমত, সমগ্র ভারত জুড়ে প্রায় ২৫ লক্ষ নিট-এ বসা ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে আমিনা আরিফ প্রথম স্থান দখল করেছেন। এটা অবশ্যই এক বিরাট কৃতিত্বের পরিচায়ক।
দ্বিতীয়ত, আমিনা আরিফ পড়াশোনা করেছেন মুম্বইয়ের এক উর্দু মিডিয়াম স্কুল থেকে। উর্দু মিডিয়ামের স্কুলকে ইদানিং অনেকেই খরচের খাতায় লিখে রেখেছেন। তাঁদের বক্তব্য, ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলে পড়াশোনা না করলে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সাফল্য পাওয়া খুবই কঠিন। কিন্তু এই উর্দু মাধ্যমে পড়াশোনা করেও আমিনা আরিফ কিন্তু সারা ভারতের মধ্যে প্রথম র্যাঙ্ক হাসিল করেছেন। এ বিষয়ে তিনি একজন মডেল বা আদর্শস্বরূপ। তাঁর সাফল্যের কথা শুনে প্রচুর উর্দু, হিন্দি, বাংলা, তামিল বা মালায়ালম মাধ্যম স্কুলের ছেলেমেয়েরা অবশ্যই অনুপ্রেরণা পাবে।
তৃতীয় বিষয়টি হল, আমিনা আরিফ একজন হিজাবধারী তরুণী। হিজাব তাঁর শিক্ষার অগ্রগতিতে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। তিনি হিজাব পরেই সাফল্য ছিনিয়ে নিয়েছেন দেশের প্রায় ২৫ লক্ষ তরুণ-তরুণীদের মধ্য থেকে।
সম্প্রতি হিজাব নিয়ে আমাদের দেশে প্রবল বিতর্ক তৈরি হয়েছিল। কর্নাটকের পূর্বতন বিজেপি সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিতে হিজাব পরা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। মামলাটি সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গড়িয়েছে। কিন্তু মুসলিম ছাত্রীরা তাদের হিজাব বা শালীন পোষাক পরার অধিকারকে পরিত্যাগ করেনি। তারা বলেছে, আমাদের পড়াশোনা থেকে শুরু করে গবেষণা ও চাকরি-বাকরি, বা ব্যবসা আমরা হিজাব পরিধান করেই করব। তারা এ জন্য কর্নাটকে বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে জোর প্রতিবাদ করে। অন্যতম উদাহরণ হল মুসকান। যে ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনি উচ্চারণ করে হিজাব-বিরোধী গেরুয়াপন্থী ছাত্রদের শ্লোগানের মাঝে মাথা উঁচু করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বেরিয়ে আলে। সে বি¨ুমাত্র ভয় পায়নি। এদিকে আমিনা আরিফও হিজাব-বিরোধীদের যুক্ত-তর্কগুলিকে নিজের সাফল্যের মাধ্যমে খারিজ করে দিয়েছে। এটাও কম কৃতিত্বের নয়।
উর্দু মিডিয়ামের ছাত্রী আমিনার এই সাফল্য সহজে ধরা দেয়নি। পিছনে রয়েছে অনেক না বলা পরিশ্রম, অধ্যবসায়, না ঘুমানো রাত। সবথেকে বেশি বাধা ছিল ল্যাঙ্গুয়েজ ব্যারিয়ার। উর্দু মিডিয়াম হওয়ার কারণে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছিল তাঁকে। তবে দমে যাননি আমিনা। আমিনা তাঁর এই সাফল্যের সিংহভাগ কৃতিত্ব দিয়েছে স্কুল কর্তৃপক্ষকে। যারা প্রতিটা মুহূর্তে আমিনাকে সহায়তা ও উত্তম শিক্ষা প্রদান করেছেন। সেই ছোট্ট থেকেই এমবিবিএস করার ইচ্ছা ছিল আমিনার। দশম শ্রেণি পর্যন্ত উর্দু বিভাগেই পড়াশোনা করেছেন। তারপর এসভিকেএম-এর মিথিবাই কলেজে ভর্তি হন। প্রথম থেকে ইংরেজিতে দুর্বল হওয়ার কারণে নিটের পড়াশোনায় অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় তাঁকে। কিন্তু ধীরে ধীরে নিজের ‘ড্র-ব্যাকস’গুলো কাটিয়ে ওঠেন তিনি। সর্বভারতীয় মেডিক্যাল প্রবেশিকায় মোট ৬৭ জন এক নম্বর স্থান অধিকার করেছেন। আর তাঁদের মধ্যে আমিনা একজন। ৭২০ মধ্যে ৭২০ নম্বর পেয়েছেন তিনি।
আমিনা সামান্য একজন বেকারি শ্রমিকের মেয়ে। ছোট থেকেই পড়াশোনায় পারদর্শী ছিলেন তিনি। দশম শ্রেণিতে ৯৩.২০ শতাংশ অন্যদিকে, দ্বাদশ পরীক্ষায় ৯৫ শতাংশ স্কোর করেছিলেন। আমিনার ইচ্ছা দিল্লির এইমস থেকে মেডিক্যাল পড়াশোনা করা। তবে অভিভাবক ও শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার পরই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন।
ছোট থেকেই তাঁর স্বপ্ন ছিল চিকিৎসক হওয়ার। আর সেই জন্য আল্লাহর উপর ভরসা করে অক্লান্ত পরিশ্রম চালিয়ে গেছে আমিনা আরিফ।
নিটে প্রথম হওয়ার পর আমিনা সংবাদমাধ্যমে জানান, মন দিয়ে নিট পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। প্রতিদিন রুটিন-মাফিক পড়াশোনা করেছি। শিক্ষকেরা যেভাবে গাইড করেছেন, সেভাবেই পড়েছি। তবে বোর্ড পরীক্ষার প্রস্তুতির থেকে নিটের প্রস্তুতি উপর আমার জোর বেশি ছিল।’ যদিও নিট পরীক্ষায় এত ভালো র্যাঙ্ক হবে, তা কিন্তু নিজেও ভাবতে পারেনি সে।
বাংলা এবং ভারতে মুসলিম মেয়েরা লেখাপড়ায়, গবেষণায় সাফল্যের পর সাফল্য হাসিল করে চলেছে। ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা মেয়েদের দাবিয়ে রাখে, লেখাপড়ায় উৎসাহ দেয় না, এই ধরনের কথাবার্তা যে কতটা মিথ্যা তা প্রমাণ করছে আমিনা আরিফরা। ধর্মপালন, হিজাব পরিধান, পড়াশোনা এবং দারিদ্রের সঙ্গে কঠিন লড়াই সব কিছু নিয়েই আমিনা আরিফরা সাফল্যের উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে উঠছেন।