ঢাকা, ২৩ এপ্রিল: ‘আমি স্বেচ্ছায় চলে এসেছি। ভুলটা আমারই ছিল। তোমরা কাউকে দোষ দিয়ো না। আমার আর বাড়িতে ফেরার কোনো সুযোগ নেই। ১০ মিনিট পর আমার বিমান ছেড়ে দেবে। মোবাইলেও পাওয়া যাবে না। আমার নামে বদনাম ছড়িয়ে দিয়ো না।’
২ এপ্রিল ছোট বোনের মোবাইল ফোনে এই বার্তা পাঠায় বাংলাদেশের রাঙামাটির নানিয়ারচর উপজেলার বুড়িঘাট ইউনিয়নের এক পাহাড়ি তরুণী। এর এক দিন আগে থেকে তার খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না। বোনকে ওই বার্তা দিয়ে তিনি পাড়ি জমান চিনের পথে। চিনে নারীদের ব্যাপক চাহিদা আছে। এক সন্তান নীতির মারপ্যাঁচে পড়ে দেশটিতে এখন নারীর চেয়ে পুরুষের সংখ্যা অনেক বেশি। অনেক পুরুষ বিয়ের জন্য নারী পাচ্ছে না।
সেই সুযোগ কাজে লাগাতে মাঠে সক্রিয় পাচারকারী চক্র। বাংলাদেশের পাহাড়ি জাতিগোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে চিনাদের চেহারার মিল আছে। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে চক্রের সদস্যরা উন্নত জীবনযাপনের লোভ দেখিয়ে পাহাড়ি পরিবারগুলোকে রাজি করাচ্ছে। এরপর তরুণী-কিশোরীদের পাচার করা হচ্ছে চিনে। এ কাজে সুবিধার জন্য অনেক সময় এ দেশেই চিনাদের সঙ্গে বিয়ের ব্যবস্থা করা হচ্ছে বা বিয়ের জাল কাগজ তৈরি করা হচ্ছে।
ওয়াকিফাল সূত্র বলছে, এভাবে চক্রের সদস্যরা গত সাত বছরে ৮ হাজারের বেশি কিশোরী-তরুণীকে চিনে পাচার করেছে। তাদের কাউকে কাউকে যৌনপল্লিতে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। আবার অনেককে বাড়িতে আটকে রেখে শারীরিক নির্যাতন করা হয়। জীবন বাঁচাতে কেউ কেউ পালিয়ে দেশে ফিরে এসেছেন দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে। তবে পুলিশ সদর দপ্তর বলছে, চিনে নারী পাচারের বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে তাদের কাছে কোনো তথ্য নেই।
নানিয়ারচরের ভুক্তভোগী পরিবারটির সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চিনে এ যাত্রায় ওই তরুণীর সঙ্গী হয়েছে একই এলাকার আরও ছয়জন। আর পাচারকারী চক্রে নাম এসেছে লিমা চাকমা নামের এক নারীর। তিনি চট্টগ্রামের ব্যারিস্টার কলেজ এলাকায় এক ফ্ল্যাটে থাকতেন। এক বছর আগে এক চিনা নাগরিককে বিয়ে করে তিনি চিনে চলে যান। লিমার ছোট ভাই লিমন চাকমা ও বোন শোভারানী চাকমাও চক্রের সদস্য।
অনুসন্ধানে জানা যায়, লিমা চাকমাদের মতো অন্তত আরও ২৫-৩০টি চক্র পাহাড়ে কাজ করছে। পাচারের পর উদ্ধার একাধিক নারী ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পাচারের শিকার হচ্ছেন অধিকাংশ নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়েই। পরিবারে অভাব, মা-বাবার অসচেতনতা, বিয়ের প্রলোভন, চাকরি ও চিনে নাগরিকত্বের লোভে পড়ে মেয়েরা চিনাদের পাতা ফাঁদে পা দিচ্ছে। নাম প্রকাশের অনিচ্ছুক ভুক্তভোগী পরিবারের কেউ কেউ বলছেন, শিক্ষা-দীক্ষায় পিছিয়ে থাকায় মূল সমাজের সঙ্গে তাল মেলাতে না পেরেও অনেকে এ পথে পা বাড়াচ্ছে।
সবকিছু গুছিয়ে পাচারের জন্য প্রথমে কাউকে পাহাড় থেকে এনে ঢাকায় তোলা হয়। রাজধানীতে মাসখানেক রেখে নারীদের সৌন্দর্য বৃদ্ধির কাজ করা হয়। একপর্যায়ে তাদের ছবি তুলে চিন ও তাইওয়ানে থাকা পাচার চক্রের সদস্যর কাছে পাঠানো হয়। কোনো মেয়েকে পছন্দ হলে চক্রের কোনো সদস্য চিনা নাগরিককে বর বানিয়ে বাংলাদেশে পাঠায়। ভিসা পাওয়ার সুবিধার্থে চিনা নাগরিকের সঙ্গে আদালতে বিয়ের ব্যবস্থা করা হয়।
বিয়ে হলে কখনো দ্রুত, কখনো দুই-তিন মাস পর সেই নারীকে চিনে নেওয়া সম্ভব হয়। চিনে নিয়ে তাদের একপ্রকার নিলামে ওঠানো হয়। তাদের মধ্যে থেকে কাউকে সত্যি বউ করে নিয়ে যাওয়া হয়। আবার কাউকে বাসাবাড়ি বা যৌনপল্লিতে আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়।