আহমদ হাসান ইমরান: জাতীয় নির্বাচনের তারিখ ও সময় ঘোষিত হয়েছে। গণতন্ত্রের জন্য এটা প্রকৃতই এক খুশির খবর। ভারত প্রকৃত অর্থেই এক মহাদেশ। ‘নানা ভাষা নানা মত নানা পরিধান’ কবির এই কথাটি আজও ভারত সম্পর্কে এক চরম সত্য। কিন্তু ‘বিবিধের মাঝে মিলন মহান’ কবির এই বাণী কিন্তু আজ প্রশ্নের সম্মুখীন। অথচ এই চেতনাই হচ্ছে ভারতের শক্তি এবং গণতন্ত্রের পেহচান। ভারতের মহামানবের সাগর তীরে আর্য, অনার্য, হিন্দু, মুসলমান সবাইকে নিয়েই অগ্রসর হতে হবে। সব নাগরিকের একই অধিকার, যা ভারতের সংবিধানে লিপিবদ্ধ রয়েছে। ভারতের সংবিধানই হচ্ছে ভারতীয় গণতন্ত্রের মজবুত কাঠামো। দেখতে হবে গণতন্ত্রে যেন প্রকৃত অর্থেই গণমানুষের মতামতের যথার্থ প্রতিফলন ঘটে। কিন্তু লক্ষ্য করা গেছে, অনেক ক্ষেত্রেই সংবিধানের এই চেতনা নির্বাচনে প্রতিফলিত হচ্ছে না।
এবার প্রধান নির্বাচন কমিশনার রাজীব কুমার লোকসভা ভোটের তারিখ ঘোষণার সময় স্পষ্ট করে বলেছেন, প্রচারে জাত-পাত, ধর্ম ইত্যাদি বিভেদমূলক মানুষকে বিভ্রান্ত করলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। উসকানিমূলক কোনও প্ররোচনা ভোটে বরদাশ্ত করা হবে না। উত্তম বাক্য। আর ভারতের নির্বাচনে প্রথম থেকেই এই কথাগুলি প্রযোজ্য। কিন্তু দুঃখের বিষয়, অনেকেই রাম-রহিম, জাত-পাত, মন্দির-মসজিদ অন্য সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ঘৃণা প্রচারের মাধ্যমে ইভিএম-এ বাজিমাত করতে তৎপর। আর কিছু দল এ কাজে ঠিকাদারি গ্রহণ করেছে। ইতিমধ্যেই পরিষ্কার হয়ে গেছে, কোন কোন বিষয়কে সামনে রেখে নির্বাচনে অপর পক্ষকে হারানোর চেষ্টা করা হবে। আগেই বলেছি, তার মধ্যে রয়েছে, শ্রীরামকে পুরনো, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে ব্যবহার। রয়েছে ঘৃণা ভাষণ, বিদ্বেষ প্রচার। এগুলি এখন নির্বাচনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ হাতিয়ার হয়ে উঠছে।
আরও একটি বিষয়ও লক্ষণীয়, ভারতের বেশিরভাগ টেলিভিশন চ্যানেল এবং প্রধান মিডিয়াগুলি কোনও একটি বিশেষ দলের হয়ে প্রচার করছে। মিডিয়ার মালিকানা চলে গিয়েছে কয়েকটি বহুজাতিক কোম্পানির হাতে। তারা যেনতেনপ্রকারেণ নিরপেক্ষ মিডিয়াগুলিকে কবজা করেছে। ফলে নির্বাচনে মিডিয়ার অব্যাহত প্রচার যে জনমতকে প্রভাবিত করছে এবং ভবিষ্যতেও করবে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। রয়েছে তথ্য বিকৃতি, মিথ্যা প্রচারণা, ঠারেঠোরে বিদ্বেষ প্রচার। এসব বিষয় নির্বাচন কমিশন কতটা ক্ষমতাশালী কিংবা বাস্তাবে কতটা ব্যবস্থা নেবে, তাতে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে।
একইসঙ্গে রয়েছে অর্থের খেলা। সম্প্রতি নির্বাচনী বন্ড নিয়ে যে ধোকাবাজি এবং দুর্নীতির তথ্য সামনে এসেছে, তা প্রকৃতপক্ষেই ভারতের জন্য লজ্জার। সুপ্রিম কোর্ট সক্রিয় না হলে এসব তথ্য চেপে দেওয়া হচ্ছিল। তাও কিন্তু বহু তথ্য সামনে আসেনি বলেই বিশেষজ্ঞদের ধারণা।
আর একটি বিষয়ও এই নির্বাচনের আগে লক্ষ্য করা গেছে। শুধুমাত্র বিরোধী দলগুলির নেতা-কর্মী-পৃষ্ঠপোষকদের বিরুদ্ধে ইডি, সিবিআই এবং ইনকান ট্যাক্সের যথেচ্ছ ব্যবহার। দুর্নীতি হলে অবশ্য ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, কেবলমাত্র বিরোধীরাই দুর্নীতিগ্রস্ত। আর শাসক দলের রাজনীতিবিদ, নেতা, কর্মী, ব্যবসায়ী, শিল্পপতিরা হচ্ছে ধোয়া তুলসী পাতা। এই ধরনের একপেশে মনোভাব গণতন্ত্রের জন্য ধ্বংসাত্মক, যা সংকেত দেয় ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার।
তা যে যাই হোক, নির্বাচন হতে চলেছে। এই নির্বাচন যাতে শান্তিপূর্ণ, অবাধ ও নিরপেক্ষ হয় তার প্রকৃত পাহারাদার কিন্তু নাগরিকরাই।