বিশেষ প্রতিবেদন: হামাস ও ইসরাইলের মধ্যে যুদ্ধের আঁচ পড়েছে লোহিত সাগরে (রেড সি)। ইয়েমেনের অন্যতম শক্তিশালী আন্দোলন হুথি আনসারুল্লাহর যোদ্ধারা ইসরাইল, আমেরিকা ও তার মিত্রদেশগুলিকে গাজায় হামলার বিষয়ে সতর্ক করেছে। কিন্তু আনসারুল্লাহ বাহিনীর হুমকি উপেক্ষা করেই গাজায় নরসংহার চালাচ্ছে যায়নবাদীরা। এমতাবস্থায় লোহিত সাগরে ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্কিত জাহাজগুলিতে সরাসরি প্রতিশোধমূলক হামলা চালাচ্ছে হুথি আনসারুল্লাহ বাহিনী।
এদিকে, এই উত্তেজনা ও যুদ্ধ বন্ধে পদক্ষেপ না নিয়ে আমেরিকা ও ব্রিটেন ইয়েমেনে অবস্থিত আনসারুল্লাহ যোদ্ধাদের বিভিন্ন অবস্থানে ড্রোন হামলা চালাচ্ছে। এই হামলাকে ‘বর্বর’ হিসাবে উল্লেখ করেছে হুথি বাহিনী।
হুথি আনসারুল্লাহ হল ইয়েমেনভিত্তিক ইরানপন্থী ও ইরানসমর্থিত একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী। হুথি বাহিনী বলে আসছে, গাজায় ইসরাইলি বোমাবর্ষণের প্রতিক্রিয়ায় তারা লোহিত সাগরে হামলা চালাচ্ছে। এই যুদ্ধ বন্ধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ব্যর্থতার নিন্দা জানিয়েছে তারা। ডিসেম্বর থেকে প্রাথমিকভাবে ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্কিত বাণিজ্যিক জাহাজগুলিকে টার্গেট করে হুথিরা। এর জবাব আমেরিকা লোহিত সাগরে একটি বহুপাক্ষিক সামরিক জোট গঠন করে যার উদ্দেশ্য বাণিজ্যিক জাহাজগুলিকে নিরাপত্তা দেওয়া। পেন্টাগন জানাচ্ছে, মার্কিন নেতৃত্বাধীন বাহিনীতে বর্তমানে ২০টিরও বেশি দেশ রয়েছে। কিন্তু এই সংঘাতের কেন্দ্রে থাকা ইয়েমেনের হুথি আনসারুল্লাহ যোদ্ধাদের আসল পরিচয় কী?
হুথি আনসারুল্লাহ যোদ্ধা কারা?
হুথিরা আনসার আল্লাহ্ নামেও পরিচিত যার অর্থ, (আল্লাহর সমর্থক)। সশস্ত্র এই বাহিনী ইয়েমেনের অনেক এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে থাকে যার মধ্যে রয়েছে দেশটির রাজধানী সানা। সউদি আরব সীমান্তের কাছাকাছি ইয়েমেনের পশ্চিম ও উত্তরের অঞ্চলগুলিও হুথিদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। হুথিরা ১৯৯০ সালে আবির্ভূত হলেও ২০১৪ সালে তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি নতুন উচ্চতায় ওঠে যখন তারা ইয়েমেনের সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে ও এর ফলে সরকারের পতন ঘটে।
সেসময় দেশে দেখা দেয় ভয়াবহ মানবিক সংকট। এরপর ইরানের সমর্থনে অনেকগুলো বছর তারা সউদি নেতৃত্বাধীন সামরিক জোটের বিরুদ্ধে ইয়েমেনে যুদ্ধ করে। উভয়পক্ষই বেশকয়েকবার শান্তি আলোচনার চেষ্টা চালায়। যদিও বিশ্লেষকরা বলছেন, শিয়া দল হুথিদের ইরানের প্রতিনিধি বা ছায়া হিসাবে দেখা উচিত নয়। আসলে দলটির নিজস্ব কিছু স্বার্থ ও লক্ষ্য রয়েছে।
ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধের অবস্থা কী?
এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ইয়েমেনে গৃহযুদ্ধ চলছে। হুথিরা দেশের অনেক এলাকার নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখেছে। সউদি আরবের সঙ্গে হুথি বাহিনীর যুদ্ধবিরতির আলোচনাও চলছে। এদিকে, ইয়েমেনের সরকার এখন এডেন নগরীতে সক্রিয় রয়েছে, এই সরকারের প্রেসিডেন্ট হলেন রাশাদ আল-আলিমি। ২০২২ সালে ইয়েমেনের নির্বাসিত প্রেসিডেন্ট আধ রাব্বু মনসুর হাদি আল-আলিমিকে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছিলেন। এই হাদির সঙ্গে হুথি বাহিনীর সম্পর্ক ভালো ছিল না।
২০২৩ সালের মার্চে রাষ্ট্রসংঘ ইয়েমেনে ‘বিশ্বের সবচেয়ে খারপ মানবিক সংকট’ প্রত্যক্ষ করে। এর কারণ অবশ্যই ইয়েমেনের দীর্ঘ গৃহযুদ্ধ। রাষ্ট্রসংঘ বলছে, ইয়েমেনের দুই-তৃতীয়াংশ অর্থাৎ ২ কোটি ১৬ লক্ষেরও বেশি মানুষের ‘জরুরি ভিত্তিতে মানবিক সহায়তা ও নিরাপত্তা প্রয়োজন’।
অবশ্য গত বছর হুথি ও সউদি নেতৃত্বাধীন সামরিক জোটের মধ্যে সংঘর্ষ অনেকটাই কমে আসে। এর ফলস্বরূপ ইয়েমেনের হুথি বাহিনী ও সরকারি বাহিনীর মধ্যে ৩ দিন ধরে প্রায় ৮০০ বন্দি বিনিময় হয়। ওমানের মধ্যস্থতায় হুথি বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারা স্থায়ী যুদ্ধবিরতির জন্য সউদি আরবের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন। ২০২৩ সালে ইরানের সঙ্গে সউদি আরবের সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়ার পর ইয়েমেন শান্তি আলোচনার পথ আরও প্রশস্ত হয়।
লোহিত সাগরের জাহাজে কেন হামলা চালাচ্ছে হুথিরা?
হুথি যোদ্ধারা বলে আসছে, ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্কিত বা যুক্ত যেকোনও বাণিজ্যিক ও সামরিক জাহাজকে লোহিত সাগরে তারা টার্গেট করবে। এর কারণ গাজায় ইসরাইলের অব্যাহত হামলা। নভেম্বরের ১৮ তারিখ হুথিরা ‘গ্যলাক্সি লিডার’ নামে একটি কার্গো শিপ দখল করে যা ইয়েমেনিদের জন্য এখন এক পর্যটন স্থানে পরিণত হয়েছে। হুথি বাহিনীর মুখপাত্র মুহম্মদ আবদুসালাম বলছেন, ‘আমরা সকলকে জানিয়েছি যে, হুথিদের এই অভিযান গাজার ফিলিস্তিনিদের সমর্থনের জন্য।
আমরা এই আগ্রাসন ও দখলদারি দেখে চুপ করে বসতে পারি না।’ হুথি যোদ্ধারা হুমকি দিয়েছে, বৃহস্পতিবার ইয়েমেনের বিভিন্ন স্থানে আমেরিকা ও ব্রিটেনের বিমান হামলার পালটা জবাব দেওয়া হবে। ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্কিত জাহাজগুলিতে হামলা আগের মতোই জারি থাকবে। হুথি মুখপাত্র আবদুসসালাম অনলাইনে লেখেন, ‘ইয়েমেনকে ফিলিস্তিন ও গাজাকে সমর্থন করা থেকে বিরত রাখার তাদের চিন্তা ভুল।’ আরও লেখেন, ‘ইসরাইল বা অধিকৃত ফিলিস্তিনের দিকে যেকোনও বন্দরে কোনও জাহাজকে যেতে দেখলেই আমরা সেগুলিকে টার্গেট করব।’
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই যুদ্ধ ও হামলা হুথিদের বিশেষ ভাবে সহায়তা করছে।
গাজার মানুষদের সমর্থন পেয়ে ইয়েমেনে অভ্যন্তরীণভাবে হুথিরা জনপ্রিয় হয়ে উঠলেও এখন আমেরিকাসহ বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলির হামলার শিকার হওয়ায় হুথিরা বিশ্বের ব্যাপক প্রচার পাচ্ছে। ইয়েমেনের স্বীকৃত সরকার না হলেও আন্তর্জাতিক মহলে ‘ডিফ্যাক্টো’ বৈধতা পাচ্ছে হুথি বাহিনী। জানা গিয়েছে, লোহিত সাগর ও সুয়েজ ক্যানাল হয়ে বিশ্বের ৩০ শতাংশ কার্গো শিপ যাতায়াত করে থাকে। তবে এখন হুথিদের আক্রমণের ভয়ে শিপিং কোম্পানিগুলি আফ্রিকা ঘুরে ইউরোপে তাদের মাল নিয়ে যাচ্ছে।
সাম্প্রতিক উত্তেজনা ইয়েমেনের শান্তিকে প্রভাবিত করবে?
বিশ্লেষকদের দাবি, লোহিত সাগরে ভাসমান জাহাজগুলিতে হুথিদের হামলা ইয়েমেনের অভ্যন্তরীণ শান্তিকে নষ্ট করতে পারে। কারণ, দীর্ঘ গৃহযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর অনেক বাধা কাটিয়ে একটি যুদ্ধবিরতির আলোচনা গতি পেতে শুরু করেছে। ডিসেম্বরে রাষ্ট্রসংঘ যুদ্ধবিরতির আলোচনা নিয়ে ইতিবাচক অগ্রগতির কথা ঘোষণা করেছিল। কিন্তু এখন বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলছেন যে, লোহিত সাগরে হুথিদের হামলার কারণে সেই যুদ্ধবিরতির চুক্তি আরও বিলম্বিত হতে পারে।
হুথিদের হামলার কারণে আমেরিকা যে সামরিক জবাব দেবে তার ফলে যুদ্ধবিরতির সম্ভাবনা কমে আসতে পারে। বিশেষজ্ঞরা উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, সৈন্য সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার পর হুথিরা তাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে আরও প্রসারিত করার লক্ষ্য নিতে পারে। কয়েক সপ্তাহ আগে হুথিরা মারিব প্রদেশে অন্তত ৫০ হাজার সৈন্য মোতায়েন করেছে।
এই মারিবই হল আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ইয়েমেনি সরকারের শেষ শক্ত ঘাঁটি। তবে অন্যান্য বিশেষজ্ঞদের মতে, সউদি আরবের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কেরও প্রত্যাশী হতে পারে হুথি বাহিনী। এটি হলে ইয়েমেনের ভেতরে যেকোনও পদক্ষেপ নেওয়ার আগে দু’বার ভাবতে হবে হুথিদের। ফলে ইয়েমেনে উত্তেজনাও কমে আসবে।