পুবের কলম প্রতিবেদক: স্বাধীন ভারতের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী মৌলানা আবুল কালাম আজাদের ১৩৫তম জন্মদিনে প্রতিবছর সংখ্যালঘু কৃতী ব্যক্তিদের পুরস্কৃত করা হয় রাজ্যের মাদ্রাসা শিক্ষা পর্ষদ সংখ্যালঘু বিষয়ক ও মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের যৌথ উদ্যোগে। বৃহস্পতিবার মৌলানা আবুল কালামের জন্মবার্ষিকীতে ‘মৌলানা আবুল কালাম আজাদ পুরস্কার’ প্রদান করা হয় চন্দ্রযান ৩-এর সদস্য তথা মুর্শিদাবাদ নিবাসী ইসরোর বিজ্ঞানী তসিকুল ওয়ারাকে। তবে, কাজের জন্য এ দিন তিনি অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে না পারায় তাঁর তরফে পুরস্কার গ্রহণ করেন তাঁর ভ্রাতৃবধূ।
একইসঙ্গে, ১৯৬৬ সালে প্রতিষ্ঠিত ভবানীপুর গুজরাটি এডুকেশন সোসাইটির দ্বারা পরিচালিত ভবানীপুর এডুকেশন সোসাইটি কলেজ-কে দেওয়া হয় ‘বেগম রোকেয়া পুরস্কার’। কলেজের পক্ষ থেকে পুরস্কার গ্রহণ করেন প্রিন্সিপাল শুভব্রত গাঙ্গুলি।
বৃহস্পতিবার মাদ্রাসা শিক্ষা পর্ষদ আয়োজিত কলকাতার সল্টলেকে অবস্থিত দফতরের সেমিনার কক্ষে অনুষ্ঠান মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন, রাজ্যের পরিবেশ মন্ত্রী গোলাম রব্বানী, জনশিক্ষা প্রসার ও গ্রন্থাগার পরিষেবা দফতরের মন্ত্রী সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরি, রাজ্য সংখ্যালঘু কমিশনের চেয়ারম্যান ও ‘পুবের কলম’-এর সম্পাদক প্রাক্তন সাংসদ আহমদ হাসান ইমরান, নেতাজির ভ্রাতুষ্পৌত্র প্রাক্তন সাংসদ ও প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ প্রফেসর সুগত বসু, মাদ্রাসা পর্ষদের সভাপতি অধ্যাপক ড. আবু তাহের কমরুদ্দিন, সংখ্যালঘু বিষয়ক ও মাদ্রাসা শিক্ষা দফতরের সচিব ওবায়দুর রহমান, মাoাসা পর্ষদের সচিব আবদুল মান্নাফ, সহ-সচিব আজিজার রহমান, ডাইরেক্টর অফ মাদ্রাসা এডুকেশন আবিদ হোসেন, প্রাক্তন ডিএমই আরফান আলি বিশ্বাস-সহ শিক্ষা-রাজনীতির বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে বিভিন্ন দফতরের সরকারি আধিকারিকরা। দর্শকাসন ভরিয়ে রেখেছিল বিভিন্ন মাদ্রাসার ছাত্র-ছাত্রীরা। তবে, ছাত্রদের তুলনায় এ দিন ছাত্রীদের উপস্থিতি বেশি চোখে পড়ে।
বক্তৃতা দিতে গিয়ে মাদ্রাসা পর্ষদের সভাপতি অধ্যাপক ড. আবু তাহের কমরুদ্দিন বলেন, প্রতি বছরই ১১ নভেম্বর শিক্ষাদিবসেই মৌলানা আবুল কালাম আজাদের জন্মবার্ষিকী পালন করি। এবার একটু অসুবিধার জন্য আমরা আজ জন্মবার্ষিকী পালন করছি। তবে, ওই দিন অল্প আয়োজনের সঙ্গে আমরা এই দিবস পালন করেছি। প্রতিবারই আমরা বড় আকারে এই দিনটি উদ্যাপন করি।
ওবাইদুর রহমান বলেন, ‘মাদ্রাসা শিক্ষা পশ্চিমবঙ্গে উন্নত হয়েছে। সমস্ত সাহায্য করা হচ্ছে দফতরের তরফে। ডিপার্টমেন্ট থেকে শিক্ষার্থীদের জন্য সাইকেল, ট্যাব, ল্যাপটপ, মোবাইল দেওয়া হচ্ছে। সরকারের তরফে সমস্ত রকম সুবিধা দেওয়া হচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘মৌলানা আবুল কালাম আজাদ বলেছিলেন, একসময় মাদ্রাসায় অ্যাস্ট্রোনমি, মেডিসিন থেকে শুরু করে সবকিছুতেই শিক্ষা প্রদান করা হত। সেইভাবেই আজকে আমাদের আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় আছে। যেখানে বিটেক, ল’-সহ বিভিন্ন স্ট্রিমের পঠন-পাঠন চলছে। মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার সবকিছুই হচ্ছেন।’
মৌলানা আবুল কালাম প্রসঙ্গে বক্তব্য রাখতে গিয়ে রাজ্যের জনশিক্ষা প্রসার ও গ্রন্থাগার মন্ত্রী সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরি বলেন, আবুল কালাম কীভাবে নিজের স্ত্রীকে মৃত্যুশয্যায় দেখেও স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে কখনও আপস করেননি। মৌলানা আবুল কালাম আজাদ যখন জেলে ছিলেন, তখন তাঁর স্ত্রী প্রচণ্ড অসুস্থ হন। প্রায় মৃত্যুশয্যায়, সেই সময় এই মহান দেশপ্রেমিককে অনুরোধ করা হয়েছিল যে, আপনি ব্রিটিশ সরকারকে চিঠি লিখে নিজের স্ত্রীকে দেখতে যাওয়ার জন্য অনুমতি নিন। সেই অনুরোধ সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন আজাদ।
সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরি আরও বলেন, মৌলানা আজাদ দেশভাগকে সমর্থন করেননি। স্বাধীনতার দিন পর্যন্ত তিনি দেশভাগের বিরুদ্ধে কথা বলে গেছেন। এ দিন সকলের কাছে সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরি আবেদন জানান, প্রত্যেকটি মাদ্রাসাতে যেন বছরের একটি দিন মৌলানা আবুল কালাম আজাদকে নিয়ে আলোচনাসভা হয়।
রাজ্যের পরিবেশ দফতরের মন্ত্রী গোলাম রাব্বানী বলেন, ‘যাঁরা ভারতের স্বাধীনতার সময় ব্রিটিশের কাছে ক্ষমা চেয়েছিলেন তাঁদের আজকে দেশের নায়ক করে তোলার দাবি জানাচ্ছে একটি মহল। সেই দাবি আমরা কখনও মেনে নিতে পারব না।’
পশ্চিমবঙ্গ সংখ্যালঘু কমিশনে চেয়ারম্যান ও ‘পুবের কলম’-এর সম্পাদক আহমদ হাসান ইমরান তাঁর বক্তব্যের মধ্যে দিয়ে তুলে ধরেন মহিলাদের শিক্ষার অগ্রগতি ও প্রসারের ক্ষেত্রে বেগম রোকেয়ার অবদান কতটা অপরিসীম। তিনি বলেন, ইসলামে শিক্ষাকে কোনও দিন বাধা দেওয়া হয়নি। নবী (সা.) বলেছেন, জ্ঞান শিক্ষা করা প্রত্যেক নর-নারীর জন্য প্রয়োজনীয়। তিনি কখনোই বলেননি, জ্ঞান শিক্ষা শুধুমাত্র পুরুষের জন্য প্রয়োজন।
ইসলামি সভ্যতার বিকাশে সবথেকে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন মেয়েরা। প্রথম মহিলা ‘মুসলিম’ হয়েছিলেন হযরত খাদিজা (রা.)। আহমদ হাসান আরও বলেন, মরক্কোতে দুনিয়ার সবথেকে প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন একজন মহিলা। তাঁর নাম ফাতিমা। সেই বিশ্ববিদ্যালয় এখনও চলমান। এই প্রসঙ্গে বেগম রোকেয়ার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, বেগম রোকেয়া চেয়েছিলেন মেয়েরা শুধু আরবি ফার্সির প্রশিক্ষণ নয়, মেয়েরা গবেষণা করুক, শিক্ষা গ্রহণ করুক, স্বাবলম্বী হোক। সে-সময় তিনি প্রবল বাধা পেয়েছিলেন সমাজের কাছ থেকে। তবুও তিনি সংগ্রাম করে শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন।
মাদ্রাসার ছাত্রছাত্রীদের উদ্দেশ্যে আহমদ হাসান ইমরান বলেন, মৌলানা আজাদ এবং বেগম রোকেয়ার কোনও প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি না থাকা সত্ত্বেও তাঁরা ছিলেন সমাজের উচ্চস্তরের মানুষ। শিক্ষার প্রসার ঘটিয়েছেন। জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসার ঘটিয়েছেন। শুধু তাই নয়, মাদ্রাসাগুলিতে ছাত্রীদের উপস্থিতি ৭৫ শতাংশ এবং ছাত্রদের উপস্থিতি মাত্র ২৫ শতাংশ বলে উল্লেখ করেন তিনি। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, রুজি-রোজগারের তাগিদে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ছেলেরা স্কুলের গণ্ডি পার হওয়ার আগেই বাইরের রাজ্যে পাড়ি জমাচ্ছে। পাশাপাশি, রাজ্যের মাদ্রাসাগুলিতে শিক্ষক-শিক্ষিকার সংখ্যা অপ্রতুল বলেও উল্লেখ করেন সংখ্যালঘু কমিশনের চেয়ারম্যান।
এ প্রসঙ্গে, মুর্শিদাবাদের একটি স্কুলের প্রসঙ্গ উল্লেখ করেন তিনি। যেখানে তিন হাজার পড়ুয়া থাকলেও শিক্ষক-শিক্ষিকার সংখ্যা মাত্র চারজন। এই বিষয়ে মাদ্রাসা পর্ষদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তিনি।
এ দিনের অনুষ্ঠানে মৌলানা আবুল কালাম প্রসঙ্গে বক্তৃতা দিতে গিয়ে প্রাক্তন সাংসদ ও প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ নেতাজির ভ্রাতুষ্পৌত্র প্রফেসর সুগত বসু বলেন, ‘১৯৪০ সালে মৌলানা আবুল কালাম আজাদ কংগ্রেসের সভাপতি হয়েছিলেন। যুদ্ধের কারণে তিনি সভাপতি থেকে গিয়েছিলেন ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত। তাই যখন ভারতে ক্যাবিনেট মিশন এসেছিল ১৯৪৬ সালে, তখন মুসলিম লিগের সভাপতি মুহাম্মদ আলি জিন্নাহ এবং ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি মৌলানা আবুল কালাম আজাদ মেনে নিয়েছিলেন একটা ত্রিস্তরীয় কনফেডারেল বা ফেডারেল ভারতের পরিকল্পনা। ১৯৪৬ সালের জুন মাসে ঠিক হয়েছিল ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ হবে না, কিন্তু আমরা ক্ষমতা সুষম ভাবে ভাগ করে নিতে পারব। দুঃখের বিষয়, জওহরলাল নেহরু কংগ্রেসের সভাপতি হয়েই ১৯৪৬ সালের ১১ জুলাই তিনি বলে বসলেন এই গ্রুপিং প্ল্যান যেটা কংগ্রেস, মুসলিম লিগ মেনে নিয়েছে।
যেখানে বলা হয়েছে রাজ্যগুলির তিনটি গ্রুপ হবে, তারপরে একটা ফেডেরাল সেন্ট্রাল হবে, এটা নাও থাকতে পারে। এই কথা শুনে আজাদ মর্মাহত হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি নিজের লেখার মাধ্যমে বলেও গিয়েছিলেন, যে এর ফলে মুসলিম লিগ ধরেই নিয়েছিল যে কংগ্রেস আসলে গ্রহণ করেনি এই ফর্মুলা এবং সেই পরিপ্রেক্ষিতেই জিন্নাহ ডাইরেক্ট অ্যাকশনের ডাক দেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করেছিলাম হিন্দু-মুসলমান-শিখ-ইসাই সকলকে সমান অধিকার দিয়ে আমরা একটা সত্যিকারের সুন্দর ভারতীয় ইউনিয়ান গড়ে তুলতে পারব, কিন্তু সেই ১৯৪৭ সালে তাঁরা হেরে গেলেন তাঁদের কাছে, যাঁদের হাতে ইংরেজদের হাত থেকে ক্ষমতা হস্তান্তরিত হল। তাই আমাদের মনে রাখা উচিত। প্রসঙ্গত তিনি ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, সত্যিকারের আদর্শ যাঁরা আঁকড়ে ছিলেন, তাঁদের প্রতি আজকের দিনে আমাদের একটু বেশি করে শ্রদ্ধা অর্পণ করা জরুরি।’