গোলাম রাশিদ: শের-ই-বাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হক ছিলেন অবিভক্ত বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী বা প্রিমিয়ার। কলকাতার প্রথম মুসলিম মেয়র। বাংলার হিন্দু-মুসলিম জনসাধারণের কাছের মানুষ হয়ে উঠেছিলেন যুক্তবাংলার বরিশালের মানুষটি। কারমাইকেল হস্টেল, ইসলামিয়া কলেজ (অধুনা মৌলানা আজাদ কলেজ), লেডি ব্রেবোর্ন কলেজসহ নানা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও হস্টেল প্রতিষ্ঠায় তাঁর অপরিসীম অবদানের কথা বাঙালি চিরকাল স্মরণে রাখবে। হক মন্ত্রিসভা কৃষকদের সমস্যা মেটাতে যেভাবে যুগান্তকারী সব পদক্ষেপ নিয়েছিল, তার ফলে সেই সময়টি হয়ে উঠেছিল কৃষক-মজদুরদের কাছে ‘স্বর্ণযুগ’।
‘শের-ই-বঙ্গাল’ ফজলুল হক আইন পাস করে প্রাথমিক শিক্ষাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক করেছিলেন। ১৮৭৩ সালের ২৬ অক্টোবর তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন। এ বছর তাঁর জন্মের দেড়শো বছর পূর্তি হল। কিন্তু একে কেন্দ্র করে বৃহস্পতিবার কলকাতা বা পশ্চিমবঙ্গের কোথাও কি কোনও স্মরণ অনুষ্ঠান হয়েছে? পুবের কলম ছাড়া প্রথম সারির দৈনিক পত্রপত্রিকায় তাঁকে নিয়ে কোনও আর্টিকল প্রকাশিত হয়েছে? তিনি কলকাতার মেয়র ছিলেন। কর্পোরেশনে কি তাঁর ছবিতে কোনও মাল্যদান হয়েছে কিংবা রাজ্যের কোনও প্রশাসনিক ভবনে তাঁকে স্মরণ করে কোনও অনুষ্ঠান হয়েছে? দুঃখের বিষয় সবগুলোর উত্তর হবে ‘না’।
যুক্তবাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রীকে একপ্রকার বিস্মরিত হয়েছে আত্মঘাতী বাঙালি। ব্যতিক্রম ছিল কলেজ স্ট্রিট চত্বরের মহাবোধি সোসাইটি হল। ভূমিপুত্র উন্নয়ন মোর্চা অফ ইন্ডিয়া (ভূমি)-র উদ্যোগে এদিন তাঁকে স্মরণ করে একটি মনোজ্ঞ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ভূমি-র পক্ষে ড. রামিজ রাজার ডাকে এই স্মরণ অনুষ্ঠানে হাজির হয়েছিলেন রাজ্যসভার সাংসদ ও বুদ্ধিজীবী জহর সরকার, ইতিহাসবেত্তা খাজিম আহমেদ, মাইনোরিটি কমিশনের চেয়ারম্যান আহমদ হাসান ইমরান, শিক্ষাবিদ-সমাজসেবী মুন্সি আবুল কাশেম, পশ্চিমবঙ্গ ইতিহাস সংসদের যুগ্ম সম্পাদক ড. মহীতোষ গায়েন, প্রাবন্ধিক আলিমুজ্জমান, সাংবাদিক জাইদুল হক, অধ্যাপক সাইফুল্লা, তথ্যচিত্র পরিচালক মুজিবর রহমানসহ বাংলার বিশিষ্টজনেরা।
এ কে ফজলুল হকের মতো ব্যক্তিত্বের জন্মের দেড়শো বছর পার হয়ে যাচ্ছে নিতান্তই বিস্মরণের মধ্য দিয়ে, কোনও উদ্যাপন ছাড়াই। এই প্রেক্ষিতে ভূমি-র অনুষ্ঠানকে ‘ঐতিহাসিক পদক্ষেপ’ বলা চলে। বাঙালি জাতির পক্ষ থেকে তারা দায়িত্ব নিয়ে এই কাজে এগিয়ে এসেছে। মাইনোরিটি কমিশনের চেয়ারম্যান আহমদ হাসান ইমরান তাঁর ভাষণে এ কথাই তুলে ধরে বলেন, আজ এই স্মরণসভা নিছক কোনও অনুষ্ঠান নয়। এই আয়োজনের মাধ্যমে সমগ্র জাতির পক্ষ থেকে ‘ভূমি’ একটি মহান দায়িত্ব পালন করেছে এবং তাঁকে নতুন করে বোঝার চেষ্টা করে হচ্ছে।
কৃষক-শ্রমিক মুক্তি, মধ্যবিত্ত শ্রেণি তৈরি ও বাঙালি মুসলিমের পরিচিতি নির্মাণে এ কে ফজলুল হকের বিশাল অবদানের কথা তুলে ধরেন ইমরান। তিনি বলেন, ফজলুল হক বাংলার কৃষকদের মুক্তি চেয়েছিলেন। জমিদার, সুদখোর মহাজনদের হাতে চাষিরা বছরের পর বছর যেভাবে নির্যাতিত-শোষিত হত তা থেকে তাদেরকে উদ্ধারে ত্রাণকর্তা হয়ে উঠেছিলেন তিনি। কৃষকদের জন্য আন্দোলন করেছিলেন তিতুমির, হাজি শরিয়তুল্লাহ। তাদের পথ ধরে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সমস্ত চাষীদের অধিকারের জন্য তিনি লড়াই করেছেন সারাজীবন। স্লোগান দিয়েছিলেন- ‘লাঙল যার, জমি তার।’ বলেছিলেন, আমি কিচ্ছু চাই না, কৃষকদের জন্য ডালভাত চাই।’
কৃষি ঋণ আইন ও প্রজাস্বত্ব আইন পাস, ঋণ সালিশি বোর্ড গঠনে হক সাহেবের ভূমিকার কথা উল্লেখ করে ইমরান বলেন, বাংলার কৃষকদের ঘটিবাটি বিক্রি হয়ে যেত মহাজনের ঋণ চোকাতে। শের-ই-বাংলা এর সমাধান করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী হয়ে। জমিদারি উচ্ছেদ করতে আইন পাসেরও চেষ্টা করেছিলেন তিনি। জমিদার-মহাজনের চক্র থেকে বাংলার কৃষকদের মুক্ত করার চেষ্টা করেছিলেন। বাংলার মুসলমানদের শিক্ষার প্রসারে বিশেষভাবে উদ্যোগী হয়েছিলেন ফজলুল হক। কলকাতার এলিট-ভদ্রলোকদের চরম বিরোধিতা সত্ত্বেও তিনি প্রাইমারি শিক্ষা বিল পাস করিয়েছিলেন।
প্রাথমিক শিক্ষাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক করেছিলেন বলে এই ‘ভদ্রলোকেরা’ ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। তারা বলেছিলেন, চাষার ছেলেরা আবার পড়বে কী! কিন্তু ফজলুল হক চাষার ছেলেদের কথাও ভাবতেন। মধ্যশিক্ষা বিল এনেছিলেন আইনসভায়। কিন্তু ভoলোকদের বিরোধিতায় তা পাস করানো সম্ভব হয়নি। পরে এটি পাস হয়েছিল অবশ্য। কারমাইকেল হস্টেল, লেডি ব্রেবোর্ন কলেজ প্রতিষ্ঠায় তাঁর ভূমিকা অনস্বীকার্য। শিক্ষাক্ষেত্রে এক নবজাগরণ তৈরি করেছিলেন তিনি। বাঙালি মুসলমানের পরিচিতি নির্মাণ, উত্থান ও শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি গঠনে এভাবেই শের-ই-বাংলা কাজ করে গেছেন বলে জানান ইমরান।
এদিন ‘শের-ই-বাংলা: নিপীড়িত বঞ্চিত বাঙালিদের শিক্ষা ও রাজনৈতিক চেতনার দিশারী’ শীর্ষক এই আলোচনায় ইমরান ছাড়াও অংশগ্রহণ করেছিলেন খাজিম আহমেদ, জহর সরকার, মহীতোষ গায়েন। খাজিম আহমেদ বলেন, এ কে ফজলুল হক ছিলেন বাঙালি মুসলমানের রাজনৈতিক চেতনার একজন বার্তাবাহী। তিনি তাঁকে হাজার বছরের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে অভিহিত করেন। ফজলুল হককে স্বমর্যাদায় অধিষ্ঠিত করতে দারুণ মনোগ্রাহী বক্তৃতা করেন তিনি। এদিনের স্মারক বক্তৃতায় জহর সরকার এ কে ফজলুল হককে প্রতিষ্ঠা করতে চাইলেন একজন আপাদমস্তক বাঙালি নেতা হিসেবে। তাঁর বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগ ওঠে অনেক সময়। এর যুৎসই জবাব দিয়েছেন জহর সরকার। এ প্রসঙ্গে হক সাহেবের পুনর্মূল্যায়ন করতে গিয়ে তিনি জানান, ১৯১১ থেকে মুসলিমদের অধিকার আদায় ও দাবিদাওয়ার রাজনীতি নিয়ে সরব হন ফজলুল হক। সেই সময় তাঁকে শুনতে হয়েছে ‘আপনি সাম্প্রদায়িক’।
সাম্প্রদায়িক ও ‘সম্প্রদায়ভিত্তিক দাবি’ কিন্তু আলাদা। তখন উচ্চবর্ণের তথাকথিত ‘ভদ্রলোক’ শ্রেণির (যারা ছিল আসলে অবিভক্ত বাংলার মোট জনসংখ্যার মাত্র ৬ শতাংশ) মানুষ চাকরির ক্ষেত্রে ৮০ শতাংশের বেশি পদ অধিকার করে রেখেছিল। মুসলমানরা ৫১ শতাংশ হয়েও চাকরিতে তাদের প্রতিনিধিত্ব ছিল মাত্র ১০ শতাংশ। এ জন্যই তিনি লড়াই চালিয়েছিলেন মুসলমানদের হয়ে। এ জন্য তাঁকে সাম্প্রদায়িক বলা যাবে কি? কোনও সম্প্রদায়ের উন্নতির জন্য কাজ করলে তাঁকে সাম্প্রদায়িক বলা যায় না।
জহর সরকার আরও বলেন, মুসলিগ লিগের লাহোর অধিবেশনের সময় ফজলুল হককে বলা হয়েছিল আপনি উর্দুতেবলুন। তিনি বললেন, হয় ইংরেজিতে, না-হলে বাংলায় বলব! তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেছিলেন, আমি বাঙালি মুসলমান। ড. মহীতোষ গায়েন এদিন অভিযোগ করেন, বিভাজনের রাজনীতির জন্য আজ ফজলুল হককে স্মরণ করা হচ্ছে না এ দেশে। বাংলা তথা ভারতে ছড়িয়ে দিতে হবে তাঁর শিক্ষা ও রাজনৈতিক চিন্তা। ফজলুল হককে সামনে রেখে বাংলার সংস্কৃতি এগিয়ে যাক, এমনই মন্তব্য করেন মুন্সি আবুল কাশেম।
ফজলুল হকের ১৫০তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষ্যে আয়োজিত এই সভায় শের-ই-বাংলা সম্মাননা প্রদান করা হয় জহর সরকার ও মুন্সী আবুল কাশেমকে। এদিন ফজলুল হকের স্মরণে একটি বিশেষ স্মরণিকা প্রকাশিত হয়। মুজিবর রহমান পরিচালিত শের-ই-বাংলার উপর একটি তথ্যচিত্র প্রদর্শনীও হয় সভাঘরে। অন্যান্য বিশিষ্টদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন উদার আকাশ সম্পাদক ফারুক আহমেদ, সাংবাদিক মোশারফ হোসেন, প্রাবন্ধিক একরামূল হক শেখ, দীপক সাহা, ভূমি-র ওয়াহেদ মির্জা, রুহুল আমিন, মধুমিতা দাস, আবু সাইদ আহমেদ প্রমুখ।